বঙ্গসাহিত্যের নবযুগ VVGR হচ্ছে দেহ-বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব। ঘোড়ার দেহের বিশেষ গঠনের কারণ হচ্ছে, ঘোড়া তুরঙ্গম। যে ঘোড়া দৌড়বে না, তার অ্যানাটমি ঠিক জীবন্ত ঘোড়ার মতো হবার কোনো বৈধ কারণ নেই। পটস্থ ঘোড়া যে তটস্থ এ বিষয়ে বোধ হয় কোনো মতভেদ নেই। চিত্রাপিত অশ্বের অ্যানাটমি ঠিক চড়বার কিংবা হাকাবার ঘোড়ার অনুরূপ করাতেই বস্তুজ্ঞানের অভাবের পরিচয় দেওয়া হয়। চলৎশক্তিরহিত অশ্ব, অর্থাৎ যাকে চাবুক মারলে ছিড়িবে। কিন্তু নড়বে না। এহেন ঘোটক, অর্থহীন অনুকরণের প্রসাদেই জীবন্ত ঘোটকের অবিকল আকার ধারণ করে চিত্রকর্মে জন্মলাভ করে। এই পঞ্চভূতাত্মক পরিদৃশ্যমান জগতের অন্তরে একটি মানসপ্রসূত দৃশ্যজগৎ সৃষ্টি করাই চিত্রকলার উদ্দেশ্য, সুতরাং এ উভয়ের রচনার নিয়মের বৈচিত্র্য থাকা অবশ্যম্ভাবী। তথাকথিত নব্যচিত্র যে নির্দোষ কিংবা নিভুল, এমন কথা আমি বলি না। যে বিদ্যা কাল জন্মগ্রহণ করেছে, আজ যে তার অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গ-সকল সম্পূর্ণ আত্মবশে আসবে, এরূপ আশা করাও বৃথা। শিল্প হিসাবে তার নানা ত্রুটি থাকা কিছুই আশ্চর্যের বিষয় নয়। কোথায় কলার নিয়মের ব্যভিচার ঘটছে, সমালোচকদের তাই দেখিয়ে দেওয়া কর্তব্য। অস্থি নয় বর্ণের সংস্থানে, পেশী নয় রেখার বন্ধনে— যেখানে অসংগতি এবং শিথিলতা দেখা যায়, সেইস্থলেই সমালোচনার সার্থকতা আছে। অব্যবসায়ীর অযথা নিন্দায় চিত্রশিল্পীদের মনে শুধু বিদ্রোহীভাবের উদ্রেক করে, এবং ফলে তঁরা নিজেদের দোষগুলিকেই গুণ ভ্ৰমে বুকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান। আমার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সাহিত্য, চিত্র নয়। যেহেতু এ যুগের সাহিত্য চিত্ৰসন্নাথ হয়ে উঠেছে, সেই কারণেই চিত্রকলার বিষয় উল্লেখ করতে বাধ্য হয়েছি। আমার ও-প্ৰসঙ্গ উত্থাপন করবার অপর একটি কারণ হচ্ছে এইটি দেখিয়ে দেওয়া যে, যা চিত্রকলায় দোষ বলে গণ্য তাই আবার আজকাল এ দেশে কাব্যকলায় গুণ বলে মান্য । প্ৰকৃতির সহিত লেখকদের যদি কোনোরূপ পরিচয় থাকত, তা হলে শুধু বর্ণের সঙ্গে বর্ণের যোজনা করলেই যে বর্ণনা হয়, এ বিশ্বাস তাদের মনে জন্মাত না ; এবং যে বস্তু কখনো তাদের চর্মচক্ষুর পথে উদয় হয় নি, তা অপরের মনশ্চক্ষুর সুমুখে খাড়া করে দেবার চেষ্টারূপ পণ্ডশ্রম তারা করতেন না । সম্ভবত এ যুগের লেখকদের বিশ্বাস যে, ছবির বিষয় হচ্ছে দৃশ্যাবস্তু, আর লেখার বিষয় হচ্ছে অদৃশ্য মন ; সুতরাং বাস্তবিকতা চিত্রকলায় অর্জনীয় এবং কাব্যকলায় বর্জনীয়। সাহিত্যে সেহাইকলমের কাজ করতে গিয়ে যারা শুধু কলমের কালি ঝাড়েন, তারাই কেবল নিজের মনকে প্ৰবোধ দেবার জন্য পূর্বোক্ত মিথ্যাটিকে সত্য বলে গ্রাহ করেন। ইন্দ্ৰিয়জ প্রত্যক্ষ জ্ঞানই হচ্ছে সকল জ্ঞানের মূল। স্বাত্মজ্ঞানশূন্যতা অন্তদৃষ্টির পরিচায়ক নয়। দূরদৃষ্টি লাভ করার অর্থ চােখে চালশে
পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৬৩
অবয়ব