পাতা:বৌদ্ধগান ও দোহা.djvu/২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬
মুখবন্ধ

দুঃখেঁ সুঃখেঁ একু করিআ ভুঞ্জই ইন্দীজানী।
স্বপরাপর ন চেবই দারিক সঅলানুত্তরমাণী॥
রাআ রাআ রাআরে অবর রাঅ মোহেরা বাধা।
লুই পাঅপত্র দারিক দ্বাদশ ভুঅণে লধা॥  [পত্রাঙ্ক ৫২]

 সিদ্ধাচার্য্য লুইপাদের বংশে তিলপাদ নামে আর একজন সিদ্ধাচার্য্য জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনিও সহজিয়া গান লিখিয়া গিয়াছেন। যে সকল গান পূর্ব্বে তুলিয়াছি, তাহা হইতে দেখা যাইবে যে, এগুলি কীর্ত্তনেরই পদ। সে কালেও সংকীর্ত্তন ছিল এবং সংকীর্ত্তনের গানগুলিকে পদই বলিত। তবে এখনকার কীর্ত্তনের পদকে শুধু পদ বলে, তখন ‘চর্য্যাপদ’ বলিত। এত ক্ষণে যাহা বলিয়া আসিলাম, তাহা হইতে আপনাদের বোধ হইবে যে, বৌদ্ধেরাই বুঝি সে কালে গান লিখিত। কিন্তু নাথেরাও সে কালে বাঙ্গালা লিখিত। মীননাথের একটি কবিতা পাইয়াছি, এখানে তুলিয়া দিলাম;—

কহন্তি গুরু পরমার্থের বাট
কর্ম্ম কুরঙ্গ সমাধিক পাঠ
কমল বিকসিল কহিহ ণ জমরা
কমল মধু পিবিবি ধোকে ন ভমরা॥  [পত্রাঙ্ক ৩৮]

 এ বাঙ্গালা কবিতাটি মীননাথের। অন্যান্য নাথেরা যে বাঙ্গালায় বহি লিখিয়াছিলেন, তাহারও প্রমাণ আছে। তবে এই দাঁড়াইল যে, খ্রীষ্টীয় ৯ শতাব্দীতে বৌদ্ধদিগের মধ্যে লুই সহজ-ধর্ম্ম প্রচার করেন। সেই সময় তাঁহার চেলারা অনেকে সংকীর্ত্তনের পদ লেখে ও দোঁহা লেখে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গেই অথচ তাহার একটু আগেই নাথেরা নাথপন্থ নামক ধর্ম্ম প্রচার করেন, তাহারও অনেক বহি ও কবিতা বাঙ্গালায় লেখা। নাথও অনেকগুলি ছিলেন, কেহ বৌদ্ধ ধর্ম্ম হইতে নাথপন্থ গ্রহণ করেন, কেহ কেহ হিন্দু হইতে নাথপন্থ গ্রহণ করেন। যাঁহারা বৌদ্ধ ধর্ম্ম হইতে নাথপন্থ গ্রহণ করেন, তাঁহাদের মধ্যে গোরক্ষনাথ একজন। তারানাথ বলেন,—গোরক্ষনাথ যখন বৌদ্ধ ছিলেন, তখন তাঁহার নাম ছিল অনঙ্গবজ্র। কিন্তু আমি বিশেষ প্রমাণ পাইয়াছিলাম, তখন তাঁহার নাম রমণবজ্র। নেপালের বৌদ্ধেরা গোরক্ষনাথের উপর বড় চটা। উঁহাকে তাহারা ধর্ম্মত্যাগী বলিয়া ঘৃণা করে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তাহারা মৎস্যেন্দ্রনাথকে অবলোকিতেশ্বরের অবতার বলিয়া পূজা করে। মৎস্যেন্দ্রনাথের পূর্ব্বনাম মচ্ছঘ্ননাথ, অর্থাৎ তিনি মাছ মারিতেন। বৌদ্ধদিগের স্মৃতিগ্রন্থে লেখা আছে যে, যাহারা নিরন্তর প্রাণিহত্যা করে, সে সকল জাতিকে অর্থাৎ জেলে মালা কৈবর্ত্তদিগকে বৌদ্ধ ধর্ম্মে দীক্ষিত করিবে না। সুতরাং মচ্ছঘ্ননাথ বৌদ্ধ হইতে পারেন না। কৌলদিগের সম্বন্ধে তাঁহার এক গ্রন্থ আছে, তাহা পড়িয়া বোধ হয় না যে, তিনি বৌদ্ধ ছিলেন, তিনি নাথপন্থীদিগের একজন গুরু ছিলেন, অথচ তিনি নেপালী বৌদ্ধদিগের উপাস্য দেবতা হইয়াছেন।