পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১১০
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

দেখিতে পাইলেন, সেই প্রথম তাঁহার বিশ্বাস বেগে বহিল, অর্দ্ধনিমীলিত নেত্রপল্লবে জলের রেখা দেখা দিল, হৃদয় বেগে উঠিতে পড়িতে লাগিল। বিভাকে চুম্বন করিতে গেলেন। এমন সময় দ্বারে আঘাত পড়িল, এমন সময়ে বিপদের সংবাদ শুনিতে পাইলেন। সেই যে হৃদয়ের প্রথম বিকাশ, সেই যে বাসনার প্রথম উচ্ছ্বাস, সেই যে নয়নের মােহ দৃষ্টি, তাহা পরিতৃপ্ত হইল না বলিয়া তাহারা তৃষা-কাতর হইয়া রামচন্দ্র রায়ের স্মৃতি অধিকার করিয়া রহিল। ইহা স্থায়ী প্রেমের ভাব নহে, কারণ রামচন্দ্র রায়ের লঘু হৃদয়ের পক্ষে তাহা সম্ভব নহে। একটা বিলাস দ্রব্যের প্রতি সৌখীন হৃদয়ের যেমন সহসা একটা টান পড়ে সৌখীন রামচন্দ্র রায়েরও বিভার প্রতি সেইরূপ একটা ভাব জন্মিয়াছিল। যাহা হউক, যে কারণেই হউক, রামচন্দ্র রায়ের যৌবন-স্বপ্নে বিভা জাগিতেছিল। বিভাকে পাইবার জন্য তাঁহার একটা অভিলাষ উদয় হইয়াছিল। কিন্তু যদি বিভাকে আনিতে পাঠান, তাহা হইলে সকলে কি মনে করিবে। সভাসদেরা যে তাঁহাকে স্ত্রৈণ মনে করিবে, মন্ত্রী যে মনে মনে অসন্তুষ্ট হইবে, রমাই ভাঁড় যে মনে মনে হাসিবে! তাহা ছাড়া, প্রতাপাদিত্যের তাহা হইলে কি শাস্তি হইল? শ্বশুরের উপর প্রতিহিংসা তোলা হইল কৈ? এইরূপ সাত পাঁচ ভাবিয়া বিভাকে আনিতে পাঠাইতে তাঁহার ভরসা হয় না, প্রবৃত্তি হয় না। এমন কি, বিভাকে লইয়া হাস্যপরিহাস চলিতে থাকে, তাহাতে বাধা দিতেও তাঁহার সাহস হয় না, এবং প্রতাপাদিত্যের কথা মনে করিয়া, তাহাতে বাধা দিতে তাঁহার ইচ্ছাও হয় না।

 রমাই ভাঁড় ও মন্ত্রী চলিয়া গেলে রামমােহন মাল আসিয়া যােড় হাতে কহিল “মহারাজ!”

 রাজা কহিলেন, “কি রামমােহন!”

 রামমােহন “মহারাজ, আজ্ঞা দিন, আমি ঠাকুরাণীকে আনিতে যাই।”

 রাজা কহিলেন, “সে কি কথা?”