পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
৩১

 এতক্ষণের পর প্রতাপাদিত্য প্রণাম করিলেন ও উঠিয়া পিতৃব্যের সহিত কোলাকুলি করিলেন। ইতিমধ্যে মন্ত্রী আস্তে আস্তে গৃহ হইতে বাহির হইয়া গেছেন। বসন্তরায় ঈষৎ কোমল হাস্য হাসিয়া প্রতাপাদিত্যের গায়ে হাত দিয়া কহিলেন, “বসন্তরায় অনেক দিন বাঁচিয়া আছে— না প্রতাপ? সময় হইয়া আসিয়াছে, এখনাে যে কেন ডাক পড়িল না বিধাতা জানেন। কিন্তু আর অধিক বিলম্ব নাই।”

 বসন্তরায় কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, প্রতাপাদিত্য কোন উত্তর করিলেন না। বসন্তরায় আবার কহিলেন, “তবে স্পষ্ট করিয়া সমস্ত বলি। তুমি যে আমাকে ছুরি তুলিয়াছ, তাহাতে আমাকে ছুরির অপেক্ষা অধিক বাজিয়াছে। (বলিতে বলিতে তাহার চক্ষে জল আসিল) কিন্তু আমি কিছুমাত্র রাগ করি নাই। আমি কেবল তােমাকে দুটি কথা বলিব। আমাকে বধ করিও না প্রতাপ! তাহাতে তােমার ইহকাল পরকালের ভাল হইবে না। এত দিন পর্য্যন্ত যদি আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকিতে পারিলে, তবে আর দুটা দিন পারিবে না? এই টুকুর জন্য পাপের ভাগী হইবে?”

 বসন্তরায় দেখিলেন, প্রতাপাদিত্য কোন উত্তর দিলেন না; দোষ অস্বীকার করিলেন না, বা অনুতাপের কথা কহিলেন না; তৎক্ষণাৎ তিনি অন্য কথা পাড়িলেন, কহিলেন,—“প্রতাপ, একবার রায়গড়ে চল। অনেক দিন সেখানে যাও নাই। অনেক পরিবর্ত্তন দেখিবে। সৈন্যেরা এখন তলােয়ার ছাড়িয়া লাঙল ধরিয়াছে; যেখানে সৈন্যদের বাসস্থান ছিল সেখানে অতিথিশালা—”

 এমন সময়ে প্রতাপাদিত্য দূর হইতে দেখিলেন পাঠানটা পালাইবার উদ্যোগ করিতেছে। আর থাকিতে পারিলেন না। মনের মধ্যে যে নিরুদ্ধ রােষ ফুটিতেছিল, তাহা অগ্নি-উৎসের ন্যায় উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। বজ্রস্বরে বলিয়া উঠিলেন—“খবরদার উহাকে ছাড়িস্ না।