পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
৬৫

তোমাকে স্পষ্টই বলিলাম। তুমি বলিয়াই বুঝিলে না, আজ রায়বংশের কত বড় অপমান হইয়াছে, তুমি বলিয়াই আজ রায়বংশের অপমানকারীর জন্য মার্জ্জনা ভিক্ষা করিতে আসিয়াছ।”

 বসন্তরায় তখন ধীরে ধীরে বলিলেন,—“প্রতাপ, আমি বুঝিয়াছি;—তুমি যখন একবার ছুরি তোল, তখন সে ছুরি এক জনের উপর পড়িতেই চায়। আমি তাহার লক্ষ্য হইতে সরিয়া পড়িলাম বলিয়া আর একজন তাহার লক্ষ্য হইয়াছে। ভাল প্রতাপ, তোমার মনে যদি দয়া না থাকে, তোমার ক্ষুধিত ক্রোধ একজনকে যদি গ্রাস করিতেই চায়, তবে আমাকেই করুক্‌! এই তোমার খুড়ার মাথা; (বলিয়া বসন্তরায় মাথা নীচু করিয়া দিলেন) ইহা লইয়া যদি তোমার তৃপ্তি হয় তবে লও। ছুরি আন। এ মাথায় চুল নাই, এ মুখে যৌবনের রূপ নাই; যম নিমন্ত্রণ-লিপি পাঠাইয়াছে, সে সভার উপযোগী সাজসজ্জাও শেষ হইয়াছে। (বসন্তরায়ের মুখে অতি মৃদু হাস্যরেখা দেখা দিল।) কিন্তু ভাবিয়া দেখ দেখি প্রতাপ, বিভা আমাদের দুধের মেয়ে, তার যখন দুটি চক্ষু দিয়ে অশ্রু পড়িবে তখন—” বলিতে বলিতে বসন্তরায় অধীর উচ্ছ্বাসে একেবারে কাঁদিয়া উঠিলেন—“আমাকে শেষ করিয়া ফেল প্রতাপ! আমার বাঁচিয়া সুখ নাই। তাহার চোখে জল দেখিবার আগে আমাকে শেষ করিয়া ফেল।”

 প্রতাপাদিত্য এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিলেন। যখন বসন্তরায়ের কথা শেষ হইল, তখন তিনি ধীরে ধীরে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। বুঝিলেন কথাটা প্রকাশ হইয়াছে। নীচে গিয়া প্রহরীদের ডাকাইয়া আদেশ করিলেন, রাজপ্রাসাদসংলগ্ন খাল এখনি যেন বড় বড় শাল কাঠ দিয়া বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। সেই খালে রামচন্দ্র রায়ের নৌকা আছে। প্রহরীদিগকে বিশেষ করিয়া সাবধান করিয়া দিলেন, আজ রাত্রে অন্তঃপুর হইতে কেহ যেন বাহির হইতে না পারে।