পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ সেই সকল শ্লোক পদ্মপুরাণে নাই। মাধ্ব-সম্প্রদায়ের সহিত বঙ্গীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মিল শুধু সেব্য-সেবকভাব স্বীকার বিষয়ে। কিন্তু কেবল সেব্য-সেবকভাব কেন, উপাস্য, উপাসনাপ্রণালী, লক্ষ্য এবং সাধ্য-সাধনাদি বিষয়ের সমতা থাকিলেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের একত্ব প্রতিপন্ন হয় না। | ব্রহ্মের সহিত জীব ও জগতের সম্বন্ধবিষয়ে মতের প্রভেদ অনুসারেই দার্শনিকেরা সম্প্রদায়ভেদ নির্ণয় করিয়া থাকেন। জগতের সত্যতা সম্বন্ধে বৈষ্ণবাচাৰ্যদিগের দ্বিমত নাই। বৈষ্ণবাচার্যগণ শংকরের মায়াবাদ সমর্থন করেন না। শংকরের। মতে ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব স্বরূপতঃ ব্ৰহ্ম । এই মতে ব্রহ্মের সহিত জগতের সম্বন্ধের প্রশ্ন নিরর্থক, কারণ যাহার অস্তিত্ব নাই তাহা ব্রহ্মের সহিত সম্পর্কিত হইতে পারে না। বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচাৰ্যদিগের মতে জগৎ নশ্বর, কিন্তু মিথ্যা নহে। জীব স্বরূপতঃ পরব্রহ্মের দাস। শংকরাচার্য কেবলাভেদবাদী। বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যেরা জীব ও ব্রহ্মের কেবলাভেদ স্বীকার করেন না। তত্ত্ববাদী মধ্ব-সম্প্রদায়ের মতে ব্ৰহ্ম স্বতন্ত্র বা স্বাধীন তত্ত্ব, জীব ও জগৎ অস্বতন্ত্র ( ব্রহ্মের অধীন ) তত্ত্ব, উহারা চিরকালই ব্ৰহ্ম হইতে পৃথক। এই মতের নাম আত্যন্তিক ভেদবাদ। বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণকে আত্যন্তিক ভেদবাদী বলা যায় না, কারণ তাহাদের মতে ব্রহ্মের অতিরিক্ত আর কোনও তত্ত্ব নাই; জীব ও জগং ব্রহ্মের বিভিন্ন শক্তির প্রকাশমাত্র। বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ কেবলাভেদবাদীও নহেন, কারণ তাহারা ব্রহ্মের সহিত জীবের ও জগতের ভেদও স্বীকার করেন। তাহারা ভেদাভেদবাদী। কিন্তু তাহাদের ভেদাভেদবাদ ভাস্করাচার্যের ঔপচারিক ভেদাভেদবাদের ন্যায় নহে। তাহারা ব্রহ্মে উপাধিসংযােগ কল্পনা করেন না। তাহাদের মতবাদ নিম্বার্কাচার্যের স্বাভাবিক ভেদাভেদবাদের ন্যায়ও নহে। ব্রহ্মের সহিত জীব ও জগতের অভেদকে স্বাভাবিক বলিয়া মনে করিলে জীব ও জগতের দোষসমূহকে ব্রহ্মের স্বাভাবিক দোষ বলিতে হইবে। কিন্তু ব্রহ্মের দোষের কথা শ্রুতিতে নাই। বঙ্গীয় বৈষ্ণবমতে সমুদায় জীব ও জগৎ ব্রহ্মেরই শক্তি। ব্রহ্মের সহিত তাহার শক্তির যুগপৎ ভেদ এবং অভেদ সম্বন্ধ বিদ্যমান। পরস্পরবিরােধী ভেদ এবং অভেদের যুগপৎ অবস্থান যুক্তিতর্কের অগােচর হইলেও তাৰ্থাপত্তি নামক প্রমাণের বলে স্বীকার্য। ব্রহ্মের সহিত জীব ও জগতের এই যুগপৎ ভেদ ও অভেদযুক্ত সম্বন্ধটিকে বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ অচিন্ত্যভেদাভেদ আখ্যা দিয়াছেন। অচিন্ত্যভেদাভেদবাদী বঙ্গীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে পঞ্চম বৈষ্ণব সম্প্রদায় নামে অভিহিত করাই যুক্তিসংগত।________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ অপ্রাকৃত চরমতত্ত্ব বিষয়ে শব্দপ্রমাণের শ্রেষ্ঠত্ব খ্যাপন করিয়া থাকেন। প্রাকৃত বিষয়ে প্রত্যক্ষ, অনুমান, আর্ষ, উপমান, অর্থাপত্তি, অনুপলব্ধি, ঐতিহ্য, সম্ভব ও চেষ্টা প্রভৃতি প্রমাণের উপযােগিতা থাকিলেও এই সকল প্রমাণ নির্দোষ নহে, কারণ ইহারা পৌরুষেয়। সাধারণ পুরুষের ভ্ৰম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করণাপাটব প্রভৃতি দোষ থাকা অসম্ভব নহে। কিন্তু শব্দপ্রমাণে এই সকল দোষ নাই, কারণ শব্দ বা বেদাদি শাস্ত্র ব্যক্তিবিশেষের মৌলিক রচনা নহে, শব্দ অপৌরুষেয়। ইহা পরব্রহ্ম কর্তৃক প্রকটিত ; ইহা স্বতঃপ্রমাণ। প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ শব্দের প্রামাণ্য নিরসনে অসমর্থ। শব্দপ্রমাণ বা শাস্ত্রপ্রমাণের প্রতিকূল কোনও প্রমাণ স্বীকার্য নহে। অনুমানাদি প্রমাণ যে স্থলে শব্দ প্রমাণের সহায়ক হয় শুধু সেই স্থলেই তাহাদিগকে প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করা যায়। বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ শব্দ প্রমাণের প্রয়ােগক্ষেত্র বর্ধিত করিয়া লইয়াছেন। তাহাদের মতে ইতিহাস (মহাভারত) এবং পুরাণ ও পরব্রহ্মের নিঃশ্বাস প্রকটিত বাক্য এবং এই হেতু শব্দ প্রমাণের মধ্যে গণ্য। পুরাণ বেদার্থপরিপূরক ; উহা বেদতুল্য। সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভেদে পুরাণ 'প্রধানতঃ তিন প্রকার। সাত্ত্বিক পুরাণে শ্রীকৃষ্ণের, রাজসিক পুরাণে ব্রহ্মার এবং তামসিক পুরাণে শিবের মহিমা কীর্তিত হইয়াছে। পরমার্থ বিষয়ে সাত্ত্বিক পুরাণের প্রামাণ্যই শ্রেষ্ঠ । সাত্ত্বিক পুরাণসমূহের মধ্যে শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণই সর্বশ্রেষ্ঠ। ব্যাসদেব বেদ ও উপনিষদের তাৎপর্য | জ্ঞাপন করিবার জন্য যে ব্ৰহ্মসূত্র রচনা করিয়াছিলেন, গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মতে শংকরাচার্য প্রভৃতি ভাষ্যকারগণ সেই ব্ৰহ্মসূত্রের মর্মোদঘাটন করিতে পারেন নাই। ব্রহ্মসূত্রের মর্মোদঘাটন করিবার উদ্দেশ্যে স্বয়ং ব্যাসদেব শ্রীকৃষ্ণের রূপ-গুণ-লীলা বর্ণনাত্মক শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ রচনা করিয়াছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতে শ্রীমদ্ভাগবতপুরাণ ব্রহ্মসূত্রের অকৃত্রিম ভাষ্য। ইহা সর্বপ্রমাণচক্রবর্তী। ইহার প্রামাণ্যই চরম প্রামাণ্য। | বেদাদি শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়ের পারিভাষিক নাম সম্বন্ধ, চরম অভীষ্টলাভের শাস্ত্রবিহিত উপায়ের নাম অভিধেয় এবং সাধন বা উপাসনার উদ্দেশ্যের নাম প্রয়ােজন। বঙ্গীয় বৈষ্ণবমতে ভগবান সম্বন্ধ, ভক্তি অভিধেয় এবং প্রেম প্রয়ােজন।

শ্রীমদ্ভাগবতের উপর নির্ভর করিয়া বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ বলেন যে, পরতত্ত্ব এক ও অদ্বিতীয়, এই তত্ত্ব প্রাকৃত পদার্থের ন্যায় জড় নহে, উহা জ্ঞানস্বরূপ বা চিৎস্বরূপ ; | তত্ত্ববিদগণ সাধারণভাবে উহাকে অদ্বয়জ্ঞানতত্ত্ব আখ্যা

১৯