পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/২০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৭৬
মহাভারত

 ঋতুপর্ণ রথে উঠলে নল সারথি বার্ষ্ণেয়কে তুলে নিলেন এবং মহাবেগে রথ চালালেন। বার্ষ্ণেয় ভাবলে, এই বাহুক কি ইন্দ্রের সারথি মাতলি না স্বয়ং নল রাজা? বয়সে নলের তুল্য হলেও এ আকৃতিতে বিরূপ ও খর্ব। বাহুকের রথচালনা দেখে ঋতুপর্ণ বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। সহসা তাঁর উত্তরীয় উড়ে যাওয়ায় তিনি বললেন, রথ থামাও, বার্ষ্ণেয় আমার উত্তরীয় নিয়ে আসুক। নল বললেন, আমরা এক যোজন ছাড়িয়ে এসেছি, এখন উত্তরীয় পাওয়া অসম্ভব। ঋতুপর্ণ বিশেষ প্রীত হলেন না। তিনি এক বিভীতক (বহেড়া) বৃক্ষ দেখিয়ে বললেন, বাহুক, সকলে সব বিষয় জানে না, তুমি আমার গণনার শক্তি দেখ।— এই বৃক্ষ থেকে ভূমিতে পতিত পত্রের সংখ্যা এক শ এক, ফলের সংখ্যাও তাই। এর শাখায় পাঁচ কোটি পত্র আর দু হাজার পঁচানব্বই ফল আছে, তুমি গণনা ক’রে দেখ। রথ থামিয়ে নল বললেন, মহারাজ আপনি গর্ব করছেন, আমি এই বৃক্ষ কেটে ফেলে পত্র ও ফল গণনা করব। রাজা বললেন, এখন বিলম্ব করবার সময় নয়। নল বললেন, আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আর যদি যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকেন তবে সম্মুখের পথ ভাল আছে, বার্ষ্ণেয় আপনাকে নিয়ে যাক। ঋতুপর্ণ অনুনয় ক’রে বললেন, বাহুক, তোমার তুল্য সারথি পৃথিবীতে নেই, আমি তোমার শরণাপন্ন, গমনে বিঘ্ন করো না। যদি আজ সূর্যাস্তের পূর্বে বিদর্ভদেশে যেতে পার তবে তুমি যা চাইবে তাই দেব। নল বললেন, আমি পত্র আর ফল গণনা ক’রে বিদর্ভে যাব। রাজা অনিচ্ছায় বললেন, আমি শাখার এক অংশের পত্র ও ফলের সংখ্যা বলছি, তাই গণনা করে সন্তুষ্ট হও। নল শাখা কেটে গণনা করে বিস্মিত হয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার শক্তি অতি অদ্ভুত, আমাকে এই বিদ্যা শিখিয়ে দিন, তার পরিবর্তে আপনি আমার বিদ্যা অশ্বহৃদয় নিন।

 ঋতুপর্ণ অশ্বহৃদয় শিখে নলকে অক্ষহৃদয় দান করলেন। তৎক্ষণাৎ কলি কর্কোটক-বিষ বমন করতে করতে নলের দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন এবং অন্যের অদৃশ্য হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে ক্রুদ্ধ নলকে বললেন, নৃপতি, আমাকে অভিশাপ দিও না, আমি তোমাকে পরমা কীর্তি দান করব। যে লোক তোমার নাম কীর্তন করবে তার কলিভয় থাকবে না। এই ব’লে তিনি বিভীতক বৃক্ষে প্রবেশ করলেন। কলির প্রভাব থেকে মুক্ত নলের সন্তাপ দূর হ’ল, কিন্তু তখনও তিনি বিরূপ হয়ে রইলেন।