পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৩৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
উদ্‌যোগপর্ব
৩৪১

তার পর গরুড়ের সম্মতি নিয়ে গালব মাধবীকে যযাতির হস্তে প্রত্যর্পণ ক’রে বনে তপস্যা করতে গেলেন।

 যযাতি তাঁর কন্যার স্বয়ংবর করাবার ইচ্ছা করলেন। যযাতিপুত্র যদু ও পুরু ভগিনীকে রথে নিয়ে গঙ্গাযমুনাসংগমস্থ আশ্রমে গেলেন। বহু রাজা এবং নাগ যক্ষ গন্ধর্ব প্রভৃতি স্বয়ংবরে উপস্থিত হলেন, কিন্তু মাধবী সকলকে প্রত্যাখ্যান ক’রে তপোবনকেই বরণ করলেন। তিনি মৃগীর ন্যায় বনচারিণী হয়ে বিবিধ ব্রতনিয়ম ও ব্রহ্মচর্য পালন ক’রে ধর্ম সঞ্চয় করতে লাগলেন।

 দীর্ঘ আয়ু ভোগ ক’রে যযাতি স্বর্গে গেলেন। বহু বর্ষ স্বর্গবাসের পর তিনি মোহবশে দেবতা ঋষি ও মনুষ্যকে অবজ্ঞা করতে লাগলেন। স্বর্গবাসী রাজর্ষিগণ তাঁকে ধিক্‌কার দিয়ে বললেন, এ কেন স্বর্গে এল? কে একে চেনে? সকলেই বললেন, আমরা একে চিনি না। তখন যযাতির তেজ নষ্ট হ’ল, তিনি তাঁর আসন থেকে চ্যুত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে পড়তে লাগলেন। দেবরাজের এক দূত এসে তাঁকে বললেন, রাজা, তুমি অত্যন্ত মদগর্বিত, সকলকেই অপমান কর, তুমি স্বর্গবাসের যোগ্য নও, গর্বের জন্যই তোমার পতন হ’ল। যযাতি স্থির করলেন, আমি সাধুজনের মধ্যেই পতিত হব। সেই সময়ে প্রতর্দন বসুমনা শিবি ও অষ্টক নৈমিষারণ্যে বাজপেয় যজ্ঞ করছিলেন। যজ্ঞের ধূম অবলম্বন ক’রে যযাতি সেই চার রাজার মধ্যে অবতরণ করলেন। তখন মাধবীও বিচরণ করতে করতে সেখানে এলেন এবং পিতা যযাতিকে প্রণাম ক’রে বললেন, এই চার জন আমার পুত্র, আপনার দৌহিত্র। আমি যে ধর্ম সঞ্চয় করেছি তার অর্ধ আপনি নিন। প্রতর্দন প্রভৃতি রাজারা তাঁদের জননী ও মাতামহকে প্রণাম করলেন। গালবও অকস্মাৎ সেখানে এসে বললেন, রাজা, আমার তপস্যার অষ্টম ভাগ নিয়ে আপনি স্বর্গারোহণ করুন।

 সাধুজন যেমন তাঁকে চিনতে পারলেন তৎক্ষণাৎ যযাতির পতন নিবারিত হ’ল। প্রতর্দন প্রভৃতি উচ্চকণ্ঠে বললেন, আমরা সৎকর্মের ফলে যে পুণ্য লাভ করেছি তা আপনাকে দিলাম, তার প্রভাবে আপনি স্বর্গারোহণ করুন। যযাতি ভূমি স্পর্শ করলেন না, দৌহিত্রগণের উক্তির সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী ত্যাগ করে স্বর্গে উঠতে লাগলেন। দেবতারা তাঁকে সাদরে অভিনন্দন করলেন। ব্রহ্মা বললেন, মহারাজ, তুমি বহু যজ্ঞ দান ও প্রজাপালন ক’রে যে পুণ্য অর্জন করেছিলে তা তোমার অভিমানের ফলে নষ্ট হয়েছিল, তাই তুমি স্বর্গবাসীদের ধিক্কার পেয়ে পতিত হয়েছিলে। অভিমান বলগর্ব হিংসা কপটতা বা শঠতা থাকলে স্বর্গভোগ চিরস্থায়ী হয় না। উত্তম মধ্যম বা অধম কাকেও তুমি অপমান ক’রো না, গর্বিত লোকে শান্তি পায় না।