পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৫২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কর্ণপর্ব
৪৯৩

১৬। অর্জুনের ক্রোধ—কৃষ্ণের উপদেশ

 যুধিষ্ঠিরের তিরস্কার শুনে অর্জুন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হ’য়ে তাঁর খড়্‌গ ধারণ করলেন। চিত্তজ্ঞ কেশব বললেন, ধনঞ্জয়, তুমি খড়্‌গ হাতে নিলে কেন? যুদ্ধের যোগ্য কোনও লোককে এখানে দেখছি না, এখন ভীমসেন দুর্যোধনাদিকে আক্রমণ করেছেন, তুমি রাজা যুধিষ্ঠিরকে দেখতে এসেছ, তিনিও কুশলে আছেন। এই নৃপশ্রেষ্ঠকে দেখে তোমার আনন্দই হওয়া উচিত, তবে ক্রোধ হ’ল কেন? তোমার অভিপ্রায় কি?

 সর্পের ন্যায় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে অর্জুন বললেন, আমার এই গূঢ় প্রতিজ্ঞা আছে, যে আমাকে বলবে, ‘অন্য লোককে গাণ্ডীব দাও’, তার আমি শিরশ্ছেদ করব। গোবিন্দ, তোমার সমক্ষেই রাজা যুধিষ্ঠির আমাকে তাই বলেছেন। আমি ধর্মভীরু সেজন্য এঁকে বধ ক’রে আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করব, সত্যের নিকট ঋণমুক্ত হব। তুমিই বল এ সময়ে কি কর্তব্য। জগৎপিতা, তুমি ভূত ভবিষ্যৎ সবই জান, আমাকে যা বলবে তাই আমি করব।

 কৃষ্ণ বললেন, ধিক ধিক! অর্জুন, আমি বুঝেছি তুমি বৃদ্ধের নিকট উপদেশ লাভ কর নি, তাই অকালে ক্রুদ্ধ হয়েছ। তুমি ধর্মভীরু কিন্তু অপণ্ডিত; যাঁরা ধর্মের সকল বিভাগ জানেন তাঁরা এমন করেন না। যে লোক অকর্তব্য কর্মে প্রবৃত্ত হয় এবং কর্তব্য কর্মে বিরত থাকে সে পুরুষাধম। আমার মতে প্রাণিবধ না করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম, বরং অসত্য বলবে কিন্তু প্রাণিহিংসা করবে না। যিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতা, ধর্মজ্ঞ ও রাজা, নীচ লোকের ন্যায় তুমি তাঁকে কি ক’রে হত্যা করতে পার? তুমি বালকের ন্যায় প্রতিজ্ঞা করেছিলে, এখন মূঢ়তার বশে অধর্ম কার্যে উদ্যত হয়েছ। ধর্মের সূক্ষ্ম ও দুরূহ তত্ত্ব না জেনেই তুমি গুরুহত্যা করতে যাচ্ছ। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির, বিদুর বা যশস্বিনী কুন্তী যে ধর্মতত্ত্ব বলতে পারেন, আমি তাই বলছি শোন।—

সত্যস্য বচনং সাধু ন সত্যাদ্‌বিদ্যতে পরম্।
তত্ত্বেনৈব সুদুর্জ্ঞেয়ং পশ্য সত্যমনুষ্ঠিতম্॥
ভবেৎ সত্যমবক্তব্যং বক্তব্যমনৃতং ভবেৎ।
যন্ত্রানৃতং ভবেৎ সত্যং সত্যঞ্চাপানৃতং ভবেৎ॥

— সত্য বলাই ধর্মসংগত, সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কিছু নেই; কিন্তু জানবে যে সত্যানুসারে কর্মের অনুষ্ঠান উচিত কিনা তা স্থির করা অতি দুরূহ। যেখানে