পাতা:মহাভারত - রাজশেখর বসু.pdf/৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৫২
মহাভারত

এলেন। তখন ব্যাস শোকবিহ্বলা সত্যবতীর কাছে এসে বললেন, মাতা, সুখের দিন শেষ হয়েছে, পৃথিবী এখন গতযৌবনা, ক্রমশ পাপের বৃদ্ধি হবে, কৌরবদের দুর্নীতির ফলে ধর্মকর্ম লোপ পাবে। কুরুবংশের ক্ষয় যেন আপনাকে দেখতে না হয়, আপনি তপোবনে গিয়ে যোগ অবলম্বন করুন। সত্যবতী তাঁর পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাকে ব্যাসের কথা জানিয়ে বললেন, তোমরাও আমার সঙ্গে চল। তারপর তাঁরা তিনজনে বনে গিয়ে ঘোর তপস্যায় দেহ ত্যাগ ক’রে ইষ্টলোকে গেলেন।

 পঞ্চপাণ্ডব তাঁদের পিতৃগৃহে সুখে বাস করতে লাগলেন। নানাবিধ ক্রীড়ায় ভীমই সর্বাধিক শক্তি দেখাতেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের মাথা ঠোকাঠুকি করিয়ে, জলে ডুবিয়ে এবং অন্যান্য প্রকারে নিগ্রহ করতেন। বাহুযুদ্ধে, গমনের বেগে বা ব্যায়ামের অভ্যাসে কেউ তাঁকে হারাতে পারত না। ভীমের মনে কোনও বিদ্বেষ ছিল না, তথাপি তিনি বালসুলভ প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ধার্তরাষ্ট্রগণের অপ্রিয় হলেন।

 দুর্যোধন গঙ্গাতীরে প্রমাণকোটি নামক স্থানে উদকক্রীড়ন নাম দিয়ে একটি সুসজ্জিত আবাস রচনা করলেন এবং সেখানে নানাপ্রকার খাদ্যদ্রব্য রাখিয়ে পঞ্চপাণ্ডবকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেখানকার উদ্যানে সকলে খেলাচ্ছলে পরস্পরের মুখে খাদ্য তুলে দিতে লাগলেন, সেই সুযোগে পাপমতি দুর্যোধন ভীমকে কালকূট বিষ মিশ্রিত খাদ্য দিলেন। জলক্রীড়ার পর সকলে বিহারগৃহে বিশ্রাম করতে গেলেন, কিন্তু ভীম অত্যন্ত শ্রান্ত এবং বিষের প্রভাবে অচেতন হয়ে গঙ্গাতীরে প’ড়ে রইলেন, দুর্যোধন তাঁকে লতা দিয়ে বেঁধে জলে ফেলে দিলেন।

 সংজ্ঞাহীন ভীম জলে নিমগ্ন হয়ে নাগলোকে উপস্থিত হলেন। মহাবিষ সর্পগণ তাঁকে দংশন করতে লাগল, সেই জঙ্গম সর্পবিষে স্থাবর কালকূট বিষ নষ্ট হ’ল। চেতনা পেয়ে ভীম তাঁর বন্ধন ছিন্ন ক’রে সর্প বধ করতে লাগলেন। তখন কতকগুলি সর্প নাগরাজ বাসুকির কাছে গিয়ে সংবাদ দিলে। বাসুকি ভীমের কাছে গিয়ে তাঁকে নিজের দৌহিত্রের দৌহিত্র, অর্থাৎ কুন্তিভোজের দৌহিত্র ব’লে চিনতে পেরে গাঢ় আলিঙ্গন করলেন। বাসুকি বললেন, একে ধনরত্ন দিয়ে সুখী কর। একজন নাগ বললে, ধন দিয়ে কি হবে, যদি আপনি তুষ্ট হয়ে থাকেন তবে এই কুমারকে রসায়ন পান করতে দিন। বাসুকির আজ্ঞায় নাগগণ ভীমকে রসায়নকুণ্ডের কাছে নিয়ে গেল। ভীম স্বস্ত্যয়ন ক’রে শুচি হয়ে পূর্বমুখে বসলেন এবং এক নিঃশ্বাসে এক-একটি কুণ্ডের রস পান ক’রে আটটি কুণ্ড নিঃশেষ করলেন। তার পর তিনি নাগদত্ত উত্তম শয্যায় শুয়ে সুখে নিদ্রিত হলেন।