পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্নেহের জন্য, তোমার ভালবাসার জন্য, তোমারই আশায় এতদিন ছিলাম, সে আশাও সাঙ্গ হইয়াছে। আশা ছিল, তোমার পিতা আমার সহিত তোমার বিবাহ দিবেন। আমার কথায় রাগ করিও না, লজ্জা করিও না, লজ্জা বা রাগ করিবার এখন সময় নাই। তোমার পিতার মন বুঝিয়াছি, বিনীত শ্রীশচন্দ্রকে তিনি স্নেহ করেন, আমি তাহার চক্ষের শূল। শ্রীশচন্দ্রকে তিনি কন্যাদান করিবেন, তাহা কি আমি চক্ষে দেখিব? তাহা দেখিয়া এই গৃহে বাস করিব? হেমলতা, মনুষ্য সে আঘাত সহ করিতে পাবে না, অথবা মুনি-ঋষির সেরূপ সহিষ্ণুতা আছে। হেমলতা, আমি ঋষি নহি। হেম, আমাকে বিদায় দাও, বীরনগরে আমার স্থান নাই”

 ক্ষণেক পরে নরেন্দ্র পুনরায় ধীরস্বরে কহিতে লাগিল, “হেমলতা, কাঁদিও না, সমস্ত জীবন কঁদিবার সময় আছে, একবার আমার কথা শুন। আমি আজি জন্মের মত চলিলাম। কোথায় যাইতেছি, কি করিব, তাহা আমি জানি না। কিন্তু সে চিন্তা করি না, জগতে লক্ষ লক্ষ প্রাণী রহিয়াছে, আমারও থাকিবার স্থান হইরে। কিন্তু এই জনাকীর্ণ জগতে আমি আজ হইতে একাকী। নানা দেশে নানা স্থানে অনেক লোক দেখিব, তাহাদের মধ্যে আমি বন্ধুশূন্য, গৃহশূন্য, একাকী। জীবনে নরেন্দ্রকে আপনার ভাবিবে, এরূপ লোক নাই, নরেন্দ্রের মৃত্যুকালে শোক করিবে, এরূপ লোক নাই।’

 হেমলতার চক্ষুজলে বস্ত্র শরীর সিক্ত হইতেছিল, এক্ষণে আর থাকিতে না পারিয়া উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিয়া উঠিল। নরেন্দ্রের চক্ষু উজ্জল, কিন্তু জলশূন্য, নরেন্দ্র আবার ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, “হেম, ক্ষণেক স্থির হও, কাঁদিও না, আমি এক্ষণে কঁদিতে পারি না। আমার মনে যে ভাব হইতেছে, তাহা ক্রন্দনে ব্যক্ত হয় না; হেম, তুমি আমাকে ভালবাস, জগতের মধ্যে কেবল তুমি এক একবার নরেন্দ্রের প্রতি সস্নেহ-দৃষ্টিতে দেখ, নরেন্দ্রের বিষয় সস্নেহ-চিত্তে ভাব; কিন্তু তোমাকে কিরূপ গাঢ় প্রণয়ের সহিত ভালবাসে, অন্ধকার, সুখশূন্য জীরনাকাশের মধ্যে একটি প্রণয়-তার প্রতি কিরূপ সতৃষ্ণনয়নে চাহিয়া থাকে, তাহা হেমলতা, জান না, বালিকার হৃদয় সে ভাব ধারণ করিতে পারে না; কিন্তু এ স্বপ্ন অদ্য সাঙ্গ হইল, জীবনের একমাত্র আলোক নির্বাণ হইল, অদ্য হইতে অন্ধকারে দেশে-দেশে, অরণ্যে অরণ্যে যাবজ্জীবন পরিভ্রমণ করিব।”

 নরেন্দ্র ক্ষণেক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল; পরে ধীরে ধীরে বলিল, “হেমলতা, আমার আর একটি কথা আছে। বাল্যকালে আমরা দুজনে এই মাধবীলতাটি পুঁতিয়াছিলাম, আমাদের ভালবাসার ন্যায় লতাটি রাড়িয়াছে, আজ আর ইহার থাকিরার আরশুক কি?”

 নরেন্দ্র সেই লতা উৎপাটন করিল ও তদ্বারা একটি কঙ্কণ প্রস্তুত করিল, ধীরে ধীরে হেমলতাকে তাহা পরাইয়া দিয়া বলিল, “হেম, ফুল যত শীঘ্র শুকায়, লতা তত শীঘ্র শুকায় না,

১৬