পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

খদ্যোতমালা ঝিকমিক করিতেছে। নরেন্দ্রকে দেখিয়া গ্রাম্যকুকুর শব্দ করিতে লাগিল; দুই একজন গৃহস্থ ঘরের দ্বার খুলিয়া চাহিয়া দেখিল; নরেন্দ্র কোনদিকে চাহিলেন না, পথ অতিবাহন করিতে লাগিলেন। গ্রামের পথ ঠিক জানেন না, স্থানে স্থানে বৃক্ষের নীচে ও ঝোপের ভিতর দিয়া যাইতে নরেন্দ্রের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হইল। নয়ে গ্রাহ করিলেন না, কতক্ষণে গ্রাম পার হইয়া আবার এক প্রান্তরে পড়িলেন।

 আবার প্রান্তর পার হইলেন, অন্য গ্রামে পড়িলেন। আবার নিঃশব্দে গ্রাম পার হইয়া গেলেন। সেই রজনীযোগে কত গ্রাম অতিক্রম করিলেন, কত দূরে যাইলেন, জানি না, নরেন্দ্রও বলিতে পারেন না।

 সমস্ত রজনী ভ্রমণ করিয়া নরেন্দ্রনাথ দূর প্রান্তরে একটি আলোক দেখিতে পাইলেন, সেই আলোেক অনুসরণ করিয়া চলিতে লাগিলেন, প্রায় এক ক্রোশ যাইয়া আলোকের নিকট পৌছিয়া দেখিলেন, কতকগুলি লোক একটি শবদাহ করিতেছে। নরেন্দ্রনাথ তখন একবার দাড়াইলেন। শব দেখিয়া একবার দাইলেন। কাষ্ঠের অগ্নি একবার জলিয়া উঠিতেছিল; আবার মধ্যে মধ্যে নিস্তেজ হইয়া যাইতেছিল। ঐরূপ স্তিমিত আলোকে নরেন্দ্রের আকৃতি ও বিকট মুখমণ্ডল এক একবার দেখা যাইতে লাগিল। যাহারা শবদাহ করিতে আসিয়াছিল, তাহারা নরেন্দ্রকে দেখিতে পাইল; শ্রান্ত পথিক মনে করিয়া নিকটে আসিতে বলিল, নরেন্দ্র নিকটে গেলেন না; পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল, নরেন্দ্র পরিচয় দিলেন না। শবদাহিগণ ক্ষণেক নরেন্দ্রের অচল, দীর্ঘ অবয়ব ও বিকৃত মুখমণ্ডলের দিতে দৃষ্টিপাত করিয়া শব ছাড়িয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিল।

 প্রত্যুষে গ্রামের স্ত্রীলোকের কলস লইয়া ঘাটে যাইতেছিল, এক দীর্ঘাকার গৌরবর্ণ বিকৃত মনুষ্যমূর্তি পথে শয়ান দেখিয়া সভয়ে পাশ কাটিয়া গেল।

 প্রাতঃকাল হইল। গ্রামের লোক সমবেত হইয়া অপরিচিত ঘোর নিদ্রাভিভূত পুরুষকে জাগাইয়া পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, সে ধীরে ধীরে উত্তর দিল, “আমার নাম নাই, আমার নিবাস নাই, আমি জগতে একাকী।” নরেন্দ্র ঘোর উন্মত্ত।

॥ আট॥

 নরেন্দ্র সেইদিনই পীড়াক্রান্ত হইলেন, গ্রামের একজন ভদ্রলোক তাহার চিকিৎসা করাইতে লাগিলেন, কিন্তু অনেকদিন তাঁহার জীবনের আশা ছিল না। অনেকদিন পর নরেন্দ্র ক্রমে আরোগ্যলাভ করিতে লাগিলেন। যখন চলিবার শক্তি হইল, তখন সেই ভদ্রলোককে যথেষ্ট ধন্যবাদ দিয়া নরেন্দ্র সে গ্রাম ত্যাগ করিলেন।

২০