পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

 বিধান জিজ্ঞাসা করে— বাবা কোথায় গেছে মা?

 শ্যামা বলে— চুলোয়।

 শ্যামা রাঁধে বাড়ে, ছেলেমেয়েদের খাওয়ায়, নিজে খায়, কিন্তু বাঘিনীর মত সব সময় সে যেন কাহাকে খুন করিবার জন্য উদ্যত হইয়া থাকে। জ্বালা তাহার কে বুঝিবে? তিনটি সন্তানের জননী, স্বামীর উপর তাহার নির্ভর অনিশ্চিত। একজন পরম বন্ধু তাহার ছিল,— রাখাল। সে তাহাকে ঠকাইয়া গিয়াছে, স্বামী আজ তাহার সঞ্চয় লইয়া পলাতক। বোকার মত কেন যে সে সেভিংস ব্যাঙ্কের খাতাখানা শীতলকে দিতে গিয়াছিল। রাত্রে শ্যামার ঘুম হয় না। শীতের রাত্রি, ঠাণ্ডা লাগিবার ভয়ে দরজা জানালা বন্ধ করিয়া দিতে হয়, শ্যামা একটা লণ্ঠন কমাইয়া রাখে, ঘরের বাতাস দূষিত হইয় ওঠে। শ্যামা বারবার মশারি ঝাড়ে, বিধানের গায়ে লেপ তুলিয়া দেয়, বুকুর কাঁথা বদলায়, মণিকে তুলিয়া ঘরের জল বাহির হওয়ার নালিটার কাছে বসায়, আরও কত কি করে। চোখে তাহার জলও আসে।

 এমনি সাতটা রাত্রি কাটাইবার পর অষ্টম রাত্রে পাগলের মত চেহারা লইয়া শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে শীতল ফিরিয়া আসিল। শ্যামা জিজ্ঞাসা করিল— খেয়ে এসেছো?

 শীতল বলিল— না।

 সেই রাত্রে শ্যামা কাঠের উনানে ভাত চাপাইয়া দিল। রান্না শেষ হইতে রাত্রি তিনটা বাজিয়া গেল। শীতল ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ডাকিয়া তুলিয়া তাহাকে খাইতে বসাইয়া শ্যামা ঘরে গিয়া শুইয়া পড়িল। কাছে বসিয়া শীতলকে খাওয়ানোর প্রবৃত্তি হইল না বলিয়া শুধু নয়, ঘুমে তাহার শরীর অবশ হইয়া আসিতেছিল।

 পরদিন শীতল শ্যামাকে একশত টাকা ফেরত দিল।

 — আর কই? বাকি টাকা কি করেছ?

 — আর তুলি নি তো?

 — তোলো নি? খাতা কই আমার?

 — খাতাটা হারিয়ে গেছে শ্যামা, কোনখানে যে ফেললাম—

 শ্যামা কাঁদিতে আরম্ভ করিয়া দিল— সব টাকা নষ্ট করে এসে আবার তুমি মিছে কথা বলছো, আমি পাঁচশো টাকা সই করে দিলাম একশো টাকা তুমি কি করে তুললে,

৬৫