পাতা:মানিক গ্রন্থাবলী.pdf/৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
জননী

উপোস করলে— চিরকাল ঘরের কোণে কাটালি, সে আনন্দ তোরা কি বুঝবি? একবার কি হল,— নীলগিরি পাহাড়ের গোড়ায় একটা গ্রামে গিয়েছি এক সাধুর সঙ্গে, গ্রামটার নাম বুঝি তুড়িগোড়িয়া, পাহাড়ের সার চলে গিয়েছে গ্রামের ধার দিয়ে। পাহাড়ে উঠে দেখতে ইচ্ছা হল। গা থেকে উড়িয়া মেয়েরা পাহাড়ের বনে কাঠ কাটতে যায়, তাদের সঙ্গে গেলাম। সে কি জঙ্গল রে শ্যামা, এইটুকু সরু পথ, দুপাশে এক পা সরাবার যে নেই, যেন গাছপালার দেয়াল গাঁথা। ফিরবার সময় পথে হাতীর পাল পড়ল, আর নামবার যো নেই। চারদিন হাতীৱ পাল পথ আটকে রইল, চারদিন আমরা নামতে পারলাম না। কি সাহস মেয়েগুলোর বলিহারি যাই, চারদিন টুঁ শব্দটি করলে না, রাত্রে আমাকে বলত ঘুমোতে, আর নিজেরা কাঠকাটা দা বাগিয়ে ধরে পাহারা দিয়ে জেগে থাকত। আর একদিন—

 সেদিন আর মামার জিনিসপত্র আনা হইল না, পরদিন গিয়া লইয়া আসিল।

 শ্যামা ভাবিয়াছিল, মামা কত জিনিস না জানি আনিবে, হয়তো আঁটিবেই না ঘরে! মামা কিন্তু আনিল ক্যাম্বিশের একটা ব্যাগ, কম্বলে জড়ানো একটা বিছানা,— লেপ, তোষক নয়, দুটো র‍্যাগ, খানতিনেক সুতির চাদর আর এই এতটুকু একটা বালিশ।

 শ্যামা অবাক হইয়া বলিল, এই নাকি তোমার জিনিস মামা?

 মামা একগাল হাসিল— ভবঘুরের কি আর রাশ রাশ জিনিস থাকে মা? ব্যাগটা হাতে করি, বিছানা বগলে নিই, চলো এবার কোথায় যাবে দিল্লী না বোম্বাই।— ব্যাগটা হাতে তুলিয়া বিছানা বগলে করিয়া মামা যাওয়ার অভিনয় করিয়া দেখাইল।

 তাই হইবে বোধ হয়। আজ এখানে কাল সেখানে করিয়া যে বেড়ায়, বাক্স প্যাঁটরার হাঙ্গামা থাকিলে তাহার চলিবে কেন? কিন্তু এমন ভবঘুরেই যদি মামা হইয়া থাকে, তবে তো টাকাকড়ি কিছুই সে করিতে পারে নাই? শ্যামা ভাবিতে ভাবিতে কাজ করে। প্রথমে সে যা ভাবিয়াছিল, বিদেশে মামা অর্থোপার্জন করিয়াছে, বেড়াইয়া বেড়াইয়াছে শুধু ছুটিছাটা সুযোগ-সুবিধামত, হয়তো তা সত্য নয়। মামার হয়তো কিছুই নাই। দেশে দেশে সম্পদ কুড়াইয়া বেড়ানোর বদলে হয়তো শুধু বাউল সন্ন্যাসীর মত উদ্দেশ্যহীনভাবেই সে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে। কিন্তু এমন যে দুঃসাহসী, কত রাজা-রাজড়ার সঙ্গে যে খাতির জমাইয়াছে, পার্থিব সম্পদ লাভের সুযোগ কি সে কখনো পায় নাই? পথে-ঘাটে লোকে তো হীরাও কুড়াইয়া পায়!

৭৯