পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/২৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOOkS. in Sbr\е মানিক রচনাসমগ্ৰ কিন্তু তবু সে যাচাই করে নিতে চায়। বুঝতে চায়, অনাথের শিষ্য কতখানি অনাথের মতো হয়েছে। হেরম্ব বলল, না, কারণ-টারণ আমার সইবে না। মালতী বউদি। খাওনি বুঝি কখনও ? কখনও খায়নি বললে মালতী বিশ্বাস করবে না মনে করে হেরম্ব বলল, একদিন খেয়েছিলাম। আমার এক ব্যারিস্টার বন্ধুর বাড়িতে। একদিনেই শখ মিটে গেছে, মালতী বউদি। সুপ্রিয়ার কথা হেরম্বের মনে পড়ছিল। একদিন একটুখানি মদ খেয়েছিল বলে তাকে সে ক্ষমা করেনি। আজ মিথ্যা বলে মালতীর কাছে তাকে আত্মসমর্থন করতে হচ্ছে। মালতী খুশি হয়ে বলল, তাহলে তোমার না খাওয়াই ভালো। সাধনের জন্য বাধ্য হযে আমাকে খেতে হয়, তাছাড়া ওতে আমার কোনো ক্ষতিই হয় না, হেরম্ব। কারণ-পান করলে তোমার নেশা হবে, আমার শুধু একাগ্রতার সাহায্য হয়। প্রক্রিয়া আছে, মন্ত্রতন্ত্র আছে—সে সব তুমি বুঝবে না, হেরম্ব। বাবা বলেন, নেশার জন্য ও সব খাওয়া মহাপাপ। আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য খাও, কোনো দোষ নেই। আনন্দ মিনতি করে বলল, আজ থাক মা। মালতী মাথা নেড়ে অস্বীকার করে চলে গেল। ঘরের মাঝখানে লণ্ঠন জ্বলছিল। কাচ পরিষ্কার, পলতে ভালো করে কাটা, আলোটা বেশ উজ্জ্বল। পূৰ্ণিমার প্রাথমিক জ্যোৎস্নার চেয়ে ঢের বেশি উজ্জ্বল। হেরম্বের মনে হল, আনন্দেব মুখ স্নান দেখাচ্ছে। আনন্দ বলল, মারা দোষ নেই। দোষ ধরিনি, আনন্দ । দোষ না ধরলে কী হবে! মেয়েমানুষ মদ খায় এ কী সহজ দোষের কথা। সুপ্রিয়াকে মনে করে হেরম্ব চুপ করে রইল। একটা জলচৌকি সামনে টেনে এনে আনন্দ তাতে বসল। কিন্তু মারি সত্যি দোষ নেই। এ সব বাবার, জন্য হয়েছে। জানেন, মারা মনে একটা ভয়ানক কষ্ট আছে। একবার পাগল হয়ে যেতে বসেছিল। এই কষ্টের জন্যে। কীসের কষ্ট? আনন্দ বিষগ্ন চিন্তিত মুখে গোলাকার আলোর শিখাটির দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ না ফিরিয়েই বলল, মা বাবাকে ভয়ানক ভালোবাসে। বাবা যদি দুদিনের জন্যও কোথাও চলে যান, মা ভেবে ভেবে ঠিক পাগলের মতো হয়ে থাকে। বাবা কিন্তু মাকে দুচোখে দেখতে পারেন না। আমার জ্ঞান হবার পর থেকে একদিন বাবাকে একটি মিষ্টিকথা বলতে শুনিনি। হেরম্ব অবাক হয়ে বলল, কিন্তু মাস্টারমশায় তো কড়া কথা বলবার লোক নন ! রেগে চেচামেচি করে না বললে বুঝি কড়া কথা বলা হয় না? আপনার সামনে মাকে আজ কী রকম অপদস্থ করলেন, দেখলেন না ? চব্বিশ ঘণ্টা এক বাড়িতে থাকি, মারি অবস্থা আমার কী আর বুঝতে বাকি আছে। এমনি মা অনেকটা শান্ত হয়ে থাকে। মদ খেলে আর রক্ষা নেই। গিয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দেবে। শুনতে পাবার ভয়ে আমি অবশ্য বাগানে পালিয়ে যাই, তবু দুচারটে কথা কানে আসে তো। আমার মন এমন খারাপ হয়ে যায়। ক্ষণিকের অবসর নিয়ে আনন্দ আবার বলল, বাবা এমন নিষ্ঠুর! কাত হয়ে আনন্দের বালিশে গাল রেখে হেরম্ব শূয়ে ছিল। বালিশে মৃগনভির মৃদু গন্ধ আছে। মালতীর দুঃখের কাহিনি শুনতে শুনতে সে স্মরণ করবার চেষ্টা করছিল। কিন্তুরীগন্ধের সঙ্গে তার মনে কার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আনন্দের উচ্চারিত নিষ্ঠুর শব্দটা তার মনকে আনন্দের দিকে ফিরিয়ে দিল ।