পাতা:মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bang labOOKS. in \Sovo SR মানিক রচনাসমগ্র ওদিকের প্রাচীর, এদিকের বাড়ি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। ঘি-পোড়া গন্ধ বাতাসে ভেসে কতদূরে গিয়ে পৌছল। কেউ জানে না। হেরম্ব আনন্দের একটা হাত চেপে ধরল। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আনন্দ বলল, তুমি সিঁড়িতে বসে নােচ দেখ। আমায় ডেকো না, আমার সঙেগ কথা বোলো না । হেরম্ব সিঁড়িতে গিয়ে বসল। আনন্দ আগুনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। হেরম্বর মনে হল আগুনের সে এত কাছে দাঁড়িয়েছে যে তার চোখের সামনে সে বুঝি ঝলসে পুড়ে যাবে। কিন্তু নৃত্যের বিপুল আয়োজন, আনন্দের উন্মত্ত উল্লাস তাকে মুক করে দিয়েছিল। আগুনের তাপে আনন্দের কষ্ট হচ্ছে বুঝেও সে কাঠের পুতুলেব মতো বসে রইল। খানিকক্ষণ আগুনের সান্নিধ্যে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে একে একে কাপড়জামা খুলে আনন্দ অর্ঘ্যের মতো আগুনে সমৰ্পণ করে দিল। তার গলায় সোনার হারে তাবিজ ছিল, বাহুতে তুলসীব মালা ছিল, হাতে ছিল সোনার চুড়ি। একে একে খুলে তাও সে আগুনে ফেলে দিল। নিরাবরণ ও নিরাভরণ হয়ে সে যে কী নৃত্যু আজ দেখাবে হেরম্ব কল্পনা করে উঠতে পারল না। আনন্দ ধীরে ধীরে আগুনকে প্ৰদক্ষিণ করতে আরম্ভ করল। অতি মৃদু তার গতি, কিন্তু চোখেব পলকে ছন্দ চোখে পড়ে। এও সেই চন্দ্ৰকলা নাচেরই ছন্দ। সে নাচে তিল তিল করে আনন্দের দেহে জীবনের সঞ্চার হয়েছিল, আজ তেমনি ক্ৰমপদ্ধতিতে সে গতি সঞ্চয় করেছে। গতির সঙেগ ধীবে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের লীলাচাঞ্চল্যের সমন্বয়, যার জন্ম চোখে পড়ে না, শুধু মনে হয়। সমগ্র নৃত্যের বুপ ক্ৰমে ক্লামে পরিস্ফুট হচ্ছে। প্রথমে আনন্দের দুটি হাত দেহের সঙ্গে মিশে ছিল, হাত দুটি যখন আগুনের কম্পিত আলোয় তরঙগ তুলে তুলে দুই দিগন্তের দিকে প্রসাবিত হযে গেল, তখন আনন্দের পরিব্রুমা অত্যন্ত দ্রুত হয়ে উঠেছে। এখন যে তার নৃত্যের পরিপূর্ণ বিকাশ, এই নৃত্যকে যে না চেনে তারও তা বোঝা কঠিন নয়। হেরম্ব বড়ো আরাম বোধ কবল। তার অশান্তি ও উদবেগ, শ্রান্তি ও জডতা মিলিয়ে গিয়ে পরিতৃপ্তিতে সে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। আনন্দের প্রথম নৃত্যের শেষে মন্দিরের সামনে সে প্রথম যে অলৌকিক অনুভূতির স্বাদ পেযেছিল, আবার তার আবির্ভাবের সম্ভাবনায় হেরম্বের দেহ হালকা, মন প্রশান্ত হয়ে গেল! কিন্তু এবারও অকস্মাৎ আনন্দের নৃত্য থেমে গেল। আগুনের আরও নিকটে সে থমকে দাঁড়াল। আগুন এখন তার মাথা ছাড়িয়ে আরও উচুতে উঠেছে, আনন্দকেও মনে হচ্ছে আগুনের শিখা। পরীক্ষণে আনন্দ কান্ত হয়ে সেই বিপুল যজ্ঞানলে ঢলে পড়ল। হেরম্ব নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে রইল। কিছু করার নেই। আনন্দ অনেক আগে মারা গেছে। শুধু চিতায় উঠবার শক্তিটুকুই তার বজায় ছিল।