পাতা:মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা.pdf/১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা
১৩

হিন্দুধর্ম সম্পর্কে মার্কসের অজ্ঞতা:

 মার্কস ভৌগোলিক ভারতবর্ষকে তুলনা করেছেন ইতালীর সঙ্গে, কারণ ভারতের মতো ইতালীর তিনদিকে সমুদ্র। কিন্তু সাধারণ ভারতবাসীকে তুলনা করেছেন দারিদ্র্যগ্রস্ত আয়ারল্যাণ্ডের অধিবাসীদের সঙ্গে। পক্ষান্তরে তাঁর শোষক-শোষিতের তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতের শাসকশ্রেণিকে তুলনা করেছেন তৎকালীন সমৃদ্ধিশালী ইতালীর লোকেদের সঙ্গে। তাই লিখছেন, “ইতালী ও আয়ারল্যাণ্ড—ভোগাবিলাসী এক জগতের সঙ্গে দুর্দশাগ্রস্ত এক জগতের এই বিচিত্র মিলন হিন্দুস্থানের প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই সূচিত। এ ধর্ম যুগপৎ যৌন তেজস্বিতা (sexual exuberence) ও আত্মনিগ্রহী কৃচ্ছ্রসাধনের ধর্ম; লিঙ্গম্ আর জগন্নাথের ধর্ম, সন্ন্যাসী ও দেবদাসীর ধর্ম।”

 অর্থাৎ মার্কস যা বলতে চেয়েছেন তার সার কথা হল— ভারতের সমৃদ্ধিশালী, শোষক শ্রেণির ধর্ম হল লিঙ্গম্, যৌন তেজস্বিতা আর দেবদাসীর ধর্ম এবং দুর্দশাগ্রস্ত শোষিত শ্রেণির ধর্ম হল আত্মনিগ্রহ, কৃচ্ছ্রসাধন ও সন্ন্যাস। অর্থাৎ মার্কসের ধারণা, ভারতের শোষিত শ্রেণির লোকেরা আর্থিক দুর্দশার জন্যই আত্মনিগ্রহ ও কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্য দিয়ে সন্ন্যাসী হয়— সোজা বাংলায়, না খেতে পেয়ে সন্ন্যাসী হয়। কাজেই মার্কসের মতে চৈতন্য মহাপ্রভু, শঙ্করাচার্য, গৌতম বুদ্ধ, স্বামী বিবেকানন্দ, সবাই না খেতে পেয়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন।

 আসল কথা হল, মার্কসের মত দেহসর্বস্ব লোকেরা যাঁরা ছোটবেলা থেকে ভোগবাদী পরিবেশের মধ্যে বড় হয়েছেন, ভোগবাদী ধ্যান-ধারণায় অভ্যস্ত হয়েছেন, তাঁদের পক্ষে এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবা বা ধারণা করা সম্ভব নয়। এরা হল ‘খাও পিও জিও’ সমাজের লোক। এরা বুঝবেন কি করে যে, কেন একজন রাজপুত্র সমস্ত ভোগবিলাস ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়। একজন মানুষ যে ত্যাগ, বৈরাগ্য ও সাধনার দ্বারা দেবত্বে উপনীত হতে পারে, এদের ধর্মও তা শিক্ষা দেয় না। এদের ধর্ম শিক্ষা দেয় যে, মানুষ হল মূলত পাপী এবং শয়তানের দ্বারা পরিচালিত। তাই একটা ভেড়া পবিত্র হতে পারে কিন্তু মানুষ কখনও পবিত্র হতে পারে না।

 কাজেই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, মার্কস যদি রামায়ণ পড়তেন তবে পিতৃসত্য রক্ষার জন্য রাজ্যপাট ছেড়ে দিয়ে স্বেচ্ছায় চৌদ্দ বছরের জন্য রামের বনবাসে যাওয়াকে নিরেট মূর্খামী বলেই মনে করতেন। পক্ষান্তর সেই পরিস্থিতিতে যদি তিনি বুদ্ধিমান ও পরাক্রমশালী ঔরঙ্গজেবের মত তিন ভাইকে হত্যা করে এবং রাজা দশরথকে বন্দী করে অযোধ্যার সিংহাসন দখল করতেন তবেই মার্কসের প্রশংসার যোগ্য হতেন।

 এখানে একটা আশ্চর্যের ব্যাপার হল, যে হিন্দুধর্মে ইন্দ্রিয় সংযম ও ইন্দ্রিয় দমন হল সকল সাধনার প্রথম শর্ত, সেই হিন্দুধর্মে মার্কস ইন্দ্রিয় পরায়ণতা ও যৌন তেজস্বিতার খবর পেলেন কোথা থেকে? বর্তমান লেখকের অনুমান যে, কোনো সূত্রে হয়তো শিবলিঙ্গের ছবি দেখার তাঁর সুযোগ হয়েছিল। তার তত্ত্বগত আসল ব্যাখ্যা না জানার ফলে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যা, যা তাঁর বুদ্ধিতে কুলিয়েছে, তাই করেছেন। আসল তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বুঝে ওঠার মত ধীশক্তি তাঁর ছিল কি না, সে প্রশ্নে না যাওয়াই ভাল।

 ঠিক একই ভাবে, অদ্বৈতবাদী ভারতবর্ষ যখন ব্রহ্মজ্ঞানে বা “সর্বং খম্বিদং ব্রহ্ম” জ্ঞানে সমস্ত প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা ও পূজা করে এবং “একং সদ্বিপ্রাঃ বহুধাবদন্তি” অনুসরণ করে বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনা করে, তখন সেটা যে মার্কসের চোখে জংলী বা pagan বলে মনে হবে