পাতা:মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা.pdf/১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬
মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা

প্রমাণ দিয়েও তা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। ভারতীয় সমাজ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণে বিভক্ত ছিল। কাজেই ইয়োরোপের মত ভারতীয় সমাজও ক্রীতাদাস ও স্বাধীন নাগরিক, এই দুই শ্রেণিতে সরাসরি বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল তা খুবই কষ্ট-কল্পনা।

 ক্রীতদাসদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে, এ ব্যাপারে রোমান লেখক ক্যাটো (Cato)-র মত হল, তাদের খাবার কাজের উপর নির্ভর করবে। বছরের যে যে সময় কৃষিকাজ সর্বাপেক্ষা শ্রমসাধ্য, তখন তাদের খাদ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে এবং অল্প খাটুনির সময় বরাদ্দ কমিয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া তিনি বাগান ও ক্ষেতের মালিকরদের পরামর্শ দিচ্ছেন, বৃদ্ধ গোরুবলদ ও পুরানো লোহালক্কড়ের সঙ্গে বয়স্ক ও রুগ্ন ক্রীতাদাসদের বেচে দিতে। সমুদ্রে ঝড় উঠলে জাহাজ হাল্কা করার জন্য ঘোড়াকে আগে জলে ফেলতে হবে, না ক্রীতদাসকে আগে জলে ফেলতে হবে? এ ব্যাপারে সিসেরো (Cicero)-র মত হল, ক্রীতদাসকেই আগে জলে ফেলা উচিত। সিসেরো, পিণ্ডার, হোরেস প্রভৃতি রোমান লেখকদের মতে দুর্ভিক্ষের সময় ক্রীতদাসদের হয় বেচে দিতে হবে, নয়তো না খেতে দিয়ে মেরে ফেলতে হবে। তা ছাড়া ওই সব লেখকরা, স্বাধীন রোমক যুবকদের সুবিধার্থে ক্রীতদাসীদের গণিকাবৃত্তি অবলম্বন করার জন্যও উপদেশ দিতেন। (এই প্রসঙ্গে আরও তথ্যের জন্য বর্তমান লেখকের “পুরুষার্থ প্রসঙ্গ: পাশ্চাত্য বনাম ভারতীয় ভাবধারা” দ্রষ্টব্য।)


ভারতে ক্রীতদাস প্রথা ছিল না:

 পক্ষান্তরে “মনুসংহিতা” থেকে তৎকালীন ভারতীয় সমাজের যে চিত্র পাওয়া যায়, এবং বিশেষ করে ঐ গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে শুদ্র সম্পর্কে যে সমস্ত শ্লোক রয়েছে তাতে দেখা যায় যে, “শূদ্র মাত্রই দাস্যকর্মের উপযুক্ত” এই কথাই বলা হয়েছে। শূদ্র মাত্রই দাস এ কথা বলা হয়নি। এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল, সংস্কৃত “দাস” শব্দের দ্বারা কেবল ক্রীতদাস বোঝায় না, সাধারণ গৃহভৃত্যকেও বোঝায়। বৃহদর্থে যে কোনো বেতনভোগী কর্মচারীও দাস। “দাসী বা দাসপত্নীতে শূদ্রের যে পুত্র হয়, ঐ পুত্র শুদ্র পিতার অনুজ্ঞামতে উহার ঔরস-পুত্রের তুল্যভাগী হইবে, ইহাই শাস্ত্রীয় বিধান” (৯/১৭৯)। মনুসংহিতার উপরিউক্ত শ্লোক প্রমাণ করেছে যে, শূদ্রেরও দাসদাসী ছিল বা থাকা সম্ভব ছিল। কাজেই শূদ্র মাত্রই দাস ছিল, মার্কসবাদীদের এই সিদ্ধান্ত সত্যের অপলাপ ও ইতিহাসের বিকৃতিকরণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ছাড়া উক্ত গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে শূদ্রের অনেক স্বাধীন পেশার উল্লেখ আছে, কিন্তু ক্রীতদাসের কোনো স্বাধীন পেশা থাকা সম্ভব নয়।

 “বৈশ্যের অভাবে শুদ্রগৃহ হইতে (ব্রাহ্মণ) ইচ্ছামত দুই বা তিনটি যজ্ঞীয় দ্রব্য গ্রহণ করিবে” (১১/১৩)। “যজ্ঞের নিমিত্ত শূদ্রের নিকট ধন যাচ্ঞা করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়” (১০/২৪)। “যদি পশুযাগ ও সোমযাগ না হইয়া থাকে তবে তদুদ্দেশ্যে শূদ্র হইতেও ধন গ্রহণ করিয়া ব্রাহ্মণ বৎসরান্তে বৈশ্বানরী ইষ্ম করিবেন” (১১/২৭)।— ইত্যাদি শ্লোকগুলি অকাট্যভাবে স্বাধীন ও বিত্তশালী শূদ্রের অস্তিত্ব স্বীকার করছে। ক্রীতদাসের কাছে কেউ আর্থিক সাহায্য চাইতে পারে না এবং তাদের কোনো স্বাধীন গৃহও থাকা সম্ভব নয়।

 “...অনুপযুক্ত ব্রাহ্মণকে রাজা ধর্মপ্রবক্তাপদে নিযুক্ত করিতে পারেন, পরক্ত সর্বগুণান্বিত ধার্মিক ও ব্যবহারজ্ঞ শূদ্রকে ঐ পদে নিযুক্ত করিতে পারেন না। যে রাজার সামনে শূদ্র ন্যায়ান্যায় ধর্ম বিচার করে সেই রাজার রাষ্ট্র শীঘ্রই পঙ্কে পতিত গোরুর ন্যায় অবসন্ন হয়” (৮/২০, ২১)। এই