বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
১১৪
মুর্শিদাবাদ-কাহিনী

উন্নেসা তাহারই অনুবর্তিনী। যখন, ষড়যন্ত্রকারিগণের ভীষণ চক্রে নিষ্পেষিত হইয়া, সিরাজ পলাশীর রণক্ষেত্রে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়া, সাধের মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করিতে বাধ্য হন, তখন তাঁহার আকুল আহবানে ও মর্মভেদী অনুনয়ে কেহই তাঁহার অনুসরণ করিতে ইচ্ছা করে নাই; কেবল সেই দেবহৃদয়া লুৎফ উন্নেসা আপনার জীবনকে অকিঞ্চিৎকর বিবেচনা করিয়া শত বিপদ মাথায় লইয়াও সিরাজের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিয়াছিলেন। নিদাঘের প্রখর রৌদ্র, বর্ষার দারুণ বর্ষণ, পদ্মার উত্তাল তরঙ্গমালা—কিছুতেই তাহাকে প্রতিনিবৃত্ত করিতে পারে নাই। যাহার আদরে আদরিণী হইয়া, লুৎফ উন্নেসা মহিষীপদবাচ্যা হইয়াছিলেন, তাঁহারই জন্য তিনি আপনার জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন। যত দিন তাঁহার পবিত্র দেহ পৃথিবীতে বর্তমান ছিল, তত দিন তিনি স্বামীর কল্যাণসম্পাদন ব্যতীত অন্য কোন কার্যে আপনাকে নিযুক্ত করেন নাই। স্বামীর দেহত্যাগের পরও তাঁহার জীবন তাহারই পরকালের কল্যাণোদ্দেশ্যেই সমর্পিত হয়। মাতামহের স্নেহলালিত, সুখস্বপ্নে বিভোর, সিরাজ নিজ সৌভাগ্যসময়ে লুৎফ উন্নেসার হৃদয়ের গভীরতা বুঝিতে পারিয়াছিলেন কিনা, জানি না; কিন্তু শেষ জীবনে রাজ্যহারা, সিংহাসনহারা হইয়া যখন ভিখারীর ন্যায় বিচরণ করিতে বাধ্য হন, তখন যে তাহা বিশিষ্টরূপে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন, তাহাতে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। দুঃখের বিষয়, লুৎফ উন্নেসার একটিও ধারাবাহিক চিত্র পাওয়া যায় না। আমরা তাহার জীবনের দুই-একটি ঘটনা সাধারণের নিকট উপস্থিত করিতেছি, ইহা হইতে তাঁহার চরিত্রের কতকটা পরিচয় পাওয়া যাইবে। সিরাজের জীবনের সহিত যাহার জীবন চিরবিজড়িত, তাঁহার কথঞ্চিৎ বিবরণ সকলেরই জান৷ আবশ্যক, এইজন্য আমরা এরূপ প্রয়াস পাইতেছি।

 লুৎফ উন্নেসা কোন উচ্চ বংশে জন্মগ্রহণ করেন নাই। তিনি বাল্যকাল হইতে ক্রীতদাসীরূপে[] নবাব আলিবর্দী খাঁর সংসারে প্রবিষ্ট হন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যখন

  1. মূল সায়ব মুতাক্ষরনে লুৎফ উন্নেসাকে সিরাজের “জারিয়া” বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। (মূল মুতাক্ষরীন ১৮২ পৃ.)। জারিয়া শব্দে ক্রীতদাসী বুঝায়; কিন্তু জারিয়াগণ নিতান্ত হীনভাবের দাসী নহে। তাঁহারা যে-সংসারে প্রবিষ্ট হয়, তাহার মধ্যে কেহ ইচ্ছ। করিলে তাহাদিগকে ভাৰ্যারূপে গ্রহণ করিতে পারেন। মুতাক্ষরীনের ইংরেজি অনুবাদক জারিয়াকে Bond-maid বলিয়া অনুবাদ করিয়াছেন, (Mutaqherin Eng. Trans., vol. I, p. 614.)। বেভারিজের মতে লুৎফ উন্নেসা হিন্দুরমণী—মোহনলালের ভগিনী। মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুরের দেওয়ান ফজলে রব্বী খাঁ বাহাদুরেরও এই মত। মুতাক্ষরীনে কিন্তু লুৎফ উন্নেসা জারিয়া অর্থাৎ ক্রীতদাসী বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। কেহ কেহ মোহনলালকে বাঙ্গালী বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন, কিন্তু তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় না। মুর্শিদাবাদের নবাবদিগের সময যে-সমস্ত বাঙ্গালী উচ্চপদাভিষিক্ত হইয়াছিলেন, তাহাদের বাসস্থানের ও তদ্বংশীযগণের আজিও পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু মোহনলাল সম্বন্ধে কিছুই পাওয়া যায় না। রামেন্দ্রসুন্দর ত্ৰিবেদী কাহার নিকট শুনিয়াছিলেন যে, মোহনলালের বংশীয়ের অদ্যপি বর্ধমানে বাস করিতেছেন। পরন্তু এ বিষয়ে বিশিষ্টরূপ অনুসন্ধান না