পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
৷৴৹

বেতনে মুদিখানায় কাজ করিতেন। অনুপযুক্ত ও অমনোযোগী বলিয়া তাঁহার সেই কাজ যায়। তাহার পরে দুই টাকা মাহিনায় তিনি একটি গ্রাম্য তহশিলদারী যোগাড় করেন। এই সূত্রে তাঁহার চাষাদের সঙ্গে অবাধভাবে মিশিবার সুযোগ হয়। চাষারা যখন তন্ময় হইয়া এই সব পালা গাইত, চন্দ্রকুমারও তাহাদের সঙ্গে তন্ময় হইয়া তাহা শুনিতেন। এইভাবে পল্লীজীবনের মাধুর্য্য ও কবিত্ব তাঁহার মনকে একেবারে দখল করিয়া বসিয়াছিল। তিনি এখন এমন সুন্দর বাঙ্গালা প্রবন্ধ লিখিতে পারেন যে, আধুনিক উচ্চশিক্ষিত নব্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সুলেখকগণের অনেকের সঙ্গেই তিনি বোধ হয় প্রতিযোগিতা করিতে সমর্থ।

 স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের আনুকূল্যে চন্দ্রকুমার দে মৈমনসিংহের গাথা সংগ্রহ করিবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নিযুক্ত হইয়াছেন। তিনি এপর্যন্ত নিম্নলিখিত পালাগুলি আমাকে সংগ্রহ করিয়া দিয়াছেনঃ—

 ১। মহুয়া—দ্বিজ কানাই প্রণীত। ২। মলুয়া—গ্রন্থকারের নাম অজ্ঞাত, কেহ কেহ অনুমান করেন চন্দ্রাবতীর লেখা। ৩। চন্দ্রাবতী ও জয়চন্দ্র—নয়ানচাঁদ ঘোষ প্রণীত। ৪। কমলা—দ্বিজ ঈশান প্রণীত। ৫। কেনারাম—চন্দ্রাবতী প্রণীত। ৬। রূপবতী—কবির নাম অজ্ঞাত। ৭। ঈশা খাঁ দেওয়ান—অজ্ঞাত। ৮। ফিরোজ খাঁ দেওয়ান। ৯। মনহর খাঁ দেওয়ান। ১০। দেওয়ান ভাবনা। ১১। ছুরত জামাল ও অধুয়া সুন্দরী—অন্ধ কবি ফকির ফৈজু প্রণীত। ১২। জিরালনী। ১৩। কাজলরেখা—অজ্ঞাত। ১৪। অসমা। ১৫। ভেলুয়া সুন্দরী। ১৬। কঙ্ক ও লীলা—রঘুসুত, দামোদর, শ্রীনাথ বানিয়া ও নয়ানচাঁদ ঘোঘ—এই চারি কবির ভণিতাযুক্ত। ১৭। মদনকুমার ও মধুমালা। ১৮। গোপিনী-কীর্ত্তন—‘স্ত্রীকবি সুলাগাইন’ কর্ত্তৃক রচিত। ১৯। দেওয়ানা মদিনা—মনসুর বয়াতি প্রণীত। ২০। বিদ্যাসুন্দর—কবিকঙ্ক প্রণীত। ২১। রামায়ণ—চন্দ্রাবতী প্রণীত।

 ইহা ছাড়াও অনেক কবি ও যাত্রাগানের পালা সংগৃহীত হইয়াছে। এই সংগ্রহ এই পর্যন্ত ১৭,২৯৭ ছত্রে দাঁড়াইয়াছে।

 পালাগানের অধিকাংশই পূর্ব্ব-মৈমনসিংহের কোন কোন যথার্থ ঘটনা অবলম্বন করিয়া রচিত হইয়াছে। যে সকল ঘটনা অশ্রুসিক্ত হইয়া লোকেরা শুনিয়াছে, যে সকল অবাধ ও অপ্রতিহত অত্যাচার যমের দুর্জয় চক্রের ন্যায় সরল নিরীহ প্রাণকে পিষিয়া চলিয়া গিয়াছে—সেই সকল অপরূপ করুণ কথা গ্রাম্য কবিরা পয়ারে গাঁথিয়া রাখিয়াছেন। তাঁহারা ছন্দের—শব্দৈশ্বর্য্যের কাঙ্গাল হইতে পারেন, তাঁহারা হয়ত বড় বড় তালমানের সন্ধান জানিতেন না, কিন্তু তাঁহাদের হৃদয় অফুরন্ত কারুণ্য ও কবিত্বের উৎসস্বরূপ ছিল। যাঁহারা