পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৷৵৹
মৈমনসিংহ-গীতিকা

লিখিয়াছিলেন, তাঁহাদের অশ্রু ফুরাইয়া গিয়াছে, কিন্তু এই সকল কাহিনীর শ্রোতাদের অশ্রু কখনও ফুরাইবে বলিয়া মনে হয় না।

 উত্তরে গারো পাহাড়, জয়ন্তা ও খাসিয়ার অসম শৈলশ্রেণী,—তাহাদের পদলেহন করিয়া এক দিকে সোমেশ্বরী ও অপর দিকে কংস ছুটিয়াছে। এই বিস্তৃত ভূখণ্ড ছাড়িয়া দক্ষিণ-পূর্ব্বে নানা ধারায় ধনু, ফুলেশ্বরী, রাজেশ্বরী, ঘোড়া-উৎরা, সুন্ধা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র ক্বচিৎ ভৈরব রবে, ক্বচিৎ বীণার ন্যায় মধুর নিক্কণে প্রবাহিত হইয়াছে। এই সকল নদ-নদীর অন্তর্ব্বর্ত্তী দেশসমূহ এককালে জলের নীচে ছিল। এ সমস্ত প্রদেশটিই এখনও বহু বিল ও জলাশয়াকীর্ণ। বিলগুলিকে তদঞ্চলে ‘হাওর’ বলে। ‘তলার হাওর’, ‘জেলের হাওর’, ‘বাবারার হাওর’, প্রভৃতি বহু বিল এই ছড়াগুলিতে উল্লিখিত আছে। বলা বাহুল্য, ‘হাওর’, ‘সায়র’ প্রভৃতি শব্দ ‘সাগর’ শব্দের অপভ্রংশ।

 উত্তরে সুষঙ্গ দূর্গাপুর ও দক্ষিণে নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের অন্তর্ব্বর্ত্তী পল্লীসমূহ বর্ণিত অধিকাংশ ঘটনার অভিনয়ক্ষেত্র।

২। পূর্ব্ব-মৈমনসিংহের রাষ্ট্রীয় অবস্থা

 খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে পূর্ব্ব-মৈমনসিংহ গুপ্ত-সম্রাট্‌গণের অধীন ছিল। তৎপরে এই প্রদেশ গুপ্ত-শাসন হইতে স্বতন্ত্র হইয়া প্রাগ্‌জ্যোতিষপুরের অন্তগত হইয়াছিল। কামরূপের শাসনে এই দেশ এক সময়ে হিন্দুধর্ম্মের একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে হুয়েনসাঙ্গ এই অঞ্চলে আসিয়াছিলেন। তিনি হিন্দুরাজা শশাঙ্কের আহ্বানে এই অঞ্চলে পদার্পণ করেন। চীন-পর্য্যটক এই সকল দেশের লোকের চরিত্র ও শিক্ষা-দীক্ষার অশেষ প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন। প্রাগ্‌জ্যোতিষপুরের অবনতির পরে পূর্ব্ব-মৈমনসিংহ কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। রাজবংশীয়, কোচ এবং হাজাং প্রভৃতি শ্রেণীর লোকেরা এই সমস্ত ক্ষুদ্র রাজ্য শাসন করিতেন। ১২৮০ খৃ: অব্দে সোমেশ্বর সিংহ নামক এক ব্রাহ্মণযোদ্ধা কোচ-রাজবংশীয় বৈশ্য গারো নামক রাজার অধিকৃত সুষঙ্গ-দুর্গাপুর রাজ্য কাড়িয়া লইয়াছিলেন। ১৪৯১ অব্দে সেরপুরে গড়জরিপার রাজা দিলীপ সামন্তকে নিহত করিয়া ফিরোজ সাহার সেনাপতি মজলিশ হুমায়ুন উক্ত গড় অধিকার করেন। সম্ভবতঃ ১৫৮০ খৃঃ অঃ ঈশা খা মস্‌নদ আলী জঙ্গলবাড়ীর লক্ষ্মণ হাজরাকে জয় করিয়া তথায় সুপ্রসিদ্ধ দেওয়ানবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবে কালিয়াজুড়ি, মদনপুর; বোকাইনগর প্রভৃতি নানা স্থানে খৃষ্টীয় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত অপরাপর রাজবংশীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃপতিরা রাজত্ব করিতেছিলেন। এই রাজ্যগুলি পরিশেষে মুসলমানগণের অধিকৃত হয়, অথবা ক্ষুদ্র করদ রাজ্যে পরিণত হইয়া মুসলমানগণের বশ্যতাস্বীকারপূর্ব্বক কথঞ্চিৎ