পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
১৷৴৹

পথে॥” (কঙ্ক ও লীলা, ৩০২ পৃঃ)। এরূপ অনেক পদ আছে, পাঠক নিজে পড়িয়া দেখিবেন।

 বস্তুতঃ এই গীতিকাগুলি পড়ার পর হইতে পূর্ব্ব-মৈমনসিংহ আমার মানসপটে পর পর ছবির উপর ছবি আঁকিয়া ফেলিয়াছে। কিশোরগঞ্জ সাব-ডিভিসনের পূর্ব্ব সীমান্তে আরালিয়া গ্রামে আমাদের অন্যতম কাব্যনায়ক চাঁদ বিনোদের শ্বশুরবাড়ী, এই খানে মলুয়ার পদ্মের পাপড়ির মত দুটি চোখের সঙ্গে বিনোদের ভ্রমরকৃষ্ণ দৃষ্টির প্রথম শুভমিলন হয়—অপরাহ্ণ কাল, সূত্যা নদীর তীরস্থ বক্‌শাইয়া গ্রামে সম্ভবতঃ চাঁদ বিনোদের বাড়ী ছিল, তথা হইতে চার-পাঁচ মাইল দূববর্তী আরালিয়াতে আসিয়া তৃণশম্পময়ী বনভূমির উপান্তে পুষ্করিণীর পাড়ে কদম গাছের তলায় দাঁড়াইয়া “ঝাড় জঙ্গলে ঘেরা” মান্দারের বেড়ায় বেষ্টিত রম্ভাবন ও জলের নীলাভ শোভা দেখিতে দেখিতে বাপীস্পর্শ শীতল বায়ুর হিল্লোলে চাঁদ বিনোদ ঘাটের উপর ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। তখন মলুয়ার মেঘের মত নিবিড় কৃষ্ণ কুস্তল তাহার পায়ে লুটাইতেছিল ও তাহার কলসীতে জল ভরিবার শব্দ শুনিয়া মেঘগর্জন মনে করিয়া কুড়া পাখী চীৎকার করিয়া উঠিয়াছিল। সেই কুডার ডাক আসন্ন বর্ষার আবেশ আনয়ন করিয়াছিল। এই আরালিয়া গ্রামের ১৩।১৪ মাইল উত্তরে ধলাই বিল, “বিস্তার ধলাই বিল পদ্ম ফুলে ভরা”[১]; এই বিলের ৭।৮ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমস্থিত জাহাঙ্গীরপুর হইতে জাহাঙ্গীর দেওয়ান ধনু নদীর একটা উপশাখা বাহিয়া একদা দ্বিপ্রহর বেলা ধলাই বিলে কুড়া শিকার করিতে আসিয়াছিলেন—সঙ্গে মলুয়া। সহসা ঝুপঝাপ্ শব্দে তরুণী নর্ত্তকীর ন্যায় ক্ষিপ্রবেগে কয়েকখানি পানসি আসিয়া দেওয়ান সাহেবের তরীখানি ঘিবিয়া লইল। মলুয়ার ভ্রাতৃগণের সেই সকল পানসি নৌকা; পিঞ্জরের দ্বার মুক্ত পাইলে বিহঙ্গী যেমন স্ফূর্তিতে উড়িয়া যায়—মলুয়া তেমনই অপূর্ব্ব ক্ষিপ্রতার সহিত ভ্রাতাদের একটা নৌকায় লাফাইয়া পড়িল—তখন “আট দাড়ী নৌকা” পদ্মবন ভাঙ্গিয়া নক্ষত্রবেগে আরালিয়ার অভিমুখে রওনা হইল[২]। এগুলি সত্যঘটনা, অথচ অপূর্ব কবিত্বময়। সেই আরালিয়৷, সেই ধলাই বিল জাহাঙ্গীরপুর ও সূত্যা নদী এখনও আছে এবং তথাকার চাষারা তাহাদের আদর্শ রমণী মলুয়ার কথা এই দুই-তিন শত বৎসরের মধ্যে একদিনও ভুলিতে পারে নাই—তাহারা এখনও নানা বাদ্যযন্ত্রসহকারে সাশ্রু নেত্রে সেই গীতি গাহিয়া থাকে।

 গিরিনদীর ন্যায় দুর্জয়শক্তিশালিনী, প্রেমের সীমাহীন আকাশের নৃত্যশীলা ময়ূরী মহুয়া জৈন্তা পাহাড় হইতে ছুটিয়া বামুনখান্দা গ্রামে আসিয়। পড়িয়াছিল। এই গ্রাম নেত্রকোণা সাব-ডিভিসনে ‘তলার হাওরের’ নিকট। বামুনকান্দা, উলুয়াকান্দা, বেদের দীঘি,

  1. মলুয়া, ৯০ পৃষ্ঠা।
  2. মলুয়া, ৯১ পৃষ্ঠা।