পাতা:মৈমনসিংহ গীতিকা (প্রথম খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
ভূমিকা
১৷৶৹

সোনাইকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল। হালিয়ারা (হুলিয়া) গ্রামটি নন্দাইল হইতে দশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে, ইহার সাত মাইল উত্তরে রঘুপুরে দয়াল নামক কোন রাজা রাজত্ব করিতেন। এই কথা লিখিবার পরে যাহা জানিতে পারা গিয়াছে তাহাতে “হালিয়াঘাট” নামক স্থানকেই ‘হুলিয়া’ বলিয়া মনে হইতেছে। এই গ্রামের নিকটবর্ত্তী বৃহৎ জঙ্গলে নাকি এখনও বিস্তৃত রাজপ্রাসাদের চিহ্ন পড়িয়া আছে। প্রায় দুই শত বৎসর পূর্ব্বে এই প্রাসাদের অধিপতি ছিলেন কেশর রায়, লৌকিক উচ্চারণে ‘কাছার রায়’। এই কেশর রায় দয়াল রাজার কেউ কি-না জানা যায় নাই, হয়ত এই রাজপ্রাসাদেই নিদান কারকুনের বিচার হইয়াছিল, এবং কমলা মহিলাজনোচিত লজ্‌জাশীলতা এবং নারীমর্য্যাদা রক্ষা করিয়া তাঁহার দুঃখের কাহিনী যেরূপ সরল কথায় বলিয়াছিলেন, তাহা করুণ কবিত্বে উপপ্লুত, নির্ভীকতায় ভরপূর এবং সংযম-সহিষ্ণুতার সারস্বরূপ। হালুয়াঘাট মৈমনসিংহ হইতে ত্রিশ মাইল উত্তরে।

 সুতরাং পূর্ব্ব-মৈমনসিংহের ঝিল ও তড়াগ. সর্প ব্যাঘ্রসঙ্কুল অরণ্যভূমি, কুড়াপাখীর গুরুগম্ভীর শব্দে নিনাদিত আকাশ, ‘বারদুয়ারী ঘর’ ও সানবাঁধা পুকুরঘাট, স্বর্ণ প্রসূ শালীধান্যক্ষেত্র ও সুরভিপূর্ণ কেয়াবন এই গাথাগুলির কল্যাণে আমাদের একান্ত পরিচিত ও প্রিয় হইয়া উঠিয়াছে। টেম্‌স নদীর সুড়ঙ্গ, নটারডেম, রোমের ভ্যাটিকান প্রভৃতি দেখিতে আমাদের আর ততটা আগ্রহ নাই, মলুয়ার পদাঙ্কলাঞ্ছিত আরালিয়া গ্রাম ও বংশদণ্ডের উর্দ্ধে রজ্‌জুর উপর নর্ত্তনশীলা মহুয়া নর্তকীর অপূর্ব নর্ত্তনের স্মৃতিবাহী বামুনকান্দা প্রভৃতি পল্লী দেখিতে যতটা ইচ্ছা পোষণ করিতেছি। এই সকল স্থানে বাঙ্গালীর ঘরের শোভা শত শতদলের মত ফুটিয়া জগৎকে যে সুষমা দেখাইয়াছিল, আমাদের পোড়া দেশের সেই অমর আলেখ্য এতকাল আমরা তাচ্ছিল্য করিয়া আসিয়াছি। এণ্ড্রোমেকি, মিসেলেণ্ডা, ডেসডেমনা ও নোরা আমাদের হৃদয়ে যে সুর জাগাইতে পারিবে না, তাহা মহুয়া ও মলুয়া জাগাইবে, ইহাতে আমার সংশয় নাই। আমাদের ললনাকুল ফুলদলকোমল হইয়াও প্রেমের তপস্যায় কিরূপ বজ্রকঠোর, তাহা এই সকল গাথা পরিষ্কারভাবে বুঝাইয়া দিবে। মৈমনসিংহের পাড়াগাঁগুলি এই গীতিকাসমূহের গুণে আমার চক্ষে শ্রেষ্ঠ তীর্থ মর্য্যাদার দাবী করিতেছে।

 ময়মনসিংহে অনেক জমিদার আছেন, তাঁহাদের কেহ কি এই সকল অমর-অমরীর লীলাভূমি—এই পল্লীগুলিতে কোন স্মৃতিচিহ্নের প্রতিষ্ঠা করিয়া তাঁহাদের দেশের প্রতি জগতের শ্রদ্ধাকর্ষণের ভিত্তি গড়িয়া দিতে পারেন না? হায়রে! আমাদের দেশের সমস্ত ধনরত্ন সমুদ্রপথে শত শত যানারোহণ করিয়া পশ্চিমে যাইতেছে, যাহা অবশিষ্ট কিছু আছে তাহাও বিলাস ও পর-মনোরঞ্জনের শতচেষ্টায় সেই পশ্চিমের অভিমুখী হইয়াই আছে।