পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

 অথচ তরী ভাসাবার ইচ্ছা আছে। যখন দেখি মানবস্রোত চলেছে―চতুর্দিকে বিচিত্র কল্লোল, উদ্দাম বেগ, প্রবল গতি, অবিশ্রাম কর্ম, তখন আমারও মন নেচে ওঠে; তখন ইচ্ছা করে বহু বৎসরের গৃহবন্ধন ছিন্ন করে একেবারে বাহির হয়ে পড়ি। কিন্তু তার পরেই রিক্ত হস্তের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবি পাথেয় কোথায়? হৃদয়ে সে অসীম আশা, জীবনে সে অশ্রান্ত বল, বিশ্বাসের সে অপ্রতিহত প্রভাব, সে নিষ্ঠা, সে সত্যপ্রিয়তা, মিথ্যার প্রতি সে বিজাতীয় ঘৃণা কোথায়! অবশেষে হবে এই―গৃহও ছাড়ব, পথে চলবারও শক্তি থাকবে না। তার চেয়ে পৃথিবীপ্রান্তে এই অজ্ঞাতবাসই ভালো, এই ক্ষুদ্র সন্তোষ এবং নির্জীব শান্তিই আমাদের যথালাভ।

 তখন বসে বসে মনকে এই বলে বোঝাই যে, আমরা যন্ত্র তৈরি করতে পারি নে, জগতের সমস্ত নিগূঢ় সংবাদ আবিষ্কার করতে পারি নে, কিন্তু ভালোবাসতে পারি, ক্ষমা করতে পারি, পরস্পরের জন্যে স্থান ছেড়ে দিতে পারি। অপেক্ষা করে দেখা যাক পৃথিবীর এই আধুনিক নবসভ্যতা কবে আমাদের কোমলতা দেখে আমাদের ভালোবাসবে, কবে আমাদের দুর্বলতা দেখে অবজ্ঞা করবে না, কবে তাদের উন্নতিযৌবনের প্রখর বলাভিমান এবং জ্ঞানাভিমান কালক্রমে নম্র হয়ে আসবে এবং আমাদের স্নেহশীলতা দেখে আমাদের প্রতি স্নেহ করবে, আমাদের প্রেমপরায়ণ হৃদয়ের প্রভাবে মানবপরিবারের মধ্যে একটুখানি সমাদরের স্থান লাভ করতে পারব।

 গোরাদের মোটা মোটা মুষ্টি, প্রচণ্ড দাপট এবং নিষ্ঠুর অসহিষ্ণুতা দেখে আপাতত সে দিন কল্পনা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। আচ্ছা নাহয় তাই হল; দুঃসাধ্য দুরাশা নিয়ে অস্থির হয়ে বেড়াবার আবশ্যক কী! নাহয় এক পাশেই পড়ে রইলুম, টাইম্‌সের জগৎ-