পাতা:য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি

রমণীও রোগের সময় প্রিয়জনকে প্রাণপণে শুশ্রূষা করে থাকেন, শোকের সময় স্বাভাবিক স্ত্রীবুদ্ধিপ্রভাবে তপ্তহৃদয়ে যথাকালে যথাবিহিত সান্ত্বনা বর্ষণ করেন, এবং অনাথ আতুর জনের প্রতি তাঁদের যে স্বাভাবিক করুণা সে তাঁদের শিক্ষার অসম্পূর্ণতার উপর কিছুমাত্র নির্ভর করছে না।

 কিন্তু পূর্বেই বলেছি এতে অনেক কাজ এবং অনেক ভাবনা বেড়ে যায়, এবং সমাজ যতই উন্নতি লাভ করে ততই তার দায়িত্ব এবং কর্তব্যের জটিলতা স্বভাবতঃই বেড়ে উঠতে থাকে। যদি আমরা বলি আমরা এতটা পেরে উঠব না, আমাদের এত উদ্যম নেই, শক্তি নেই― যদি আমাদের পিতামাতারা বলে ‘পুত্রকন্যাদের উপযুক্ত বয়স পর্যন্ত মনুষ্যত্ব শিক্ষা দিতে আমরা অশক্ত কিন্তু মানুষের পক্ষে যত সত্বর সম্ভব (এমন-কি অসম্ভব বললেও হয়) আমরা পিতামাতা হতে প্রস্তুত আছি’― যদি আমাদের ছাত্রবৃন্দ বলে ‘সংযম আমাদের পক্ষে অসাধ্য, শরীর মনের সম্পূর্ণতা-লাভের জন্যে প্রতীক্ষা করতে আমরা নিতান্তই অসমর্থ, অকালে অপবিত্র দাম্পত্য আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক এবং হিঁদুয়ানিরও সেই বিধান— আমরা চাই নে উন্নতি, চাই নে ঝঞ্ঝাট, আমাদের এই রকম ভাবেই বেশ চলে যাবে’— তবে নিরুত্তর হয়ে থাকতে হয়। কিন্তু এ কথাটুকু বলতেই হয় যে, হীনতাকে হীনতা ব’লে অনুভব করাও ভালো, কিন্তু বুদ্ধিবলে নির্জীবতাকে সাধুতা এবং অক্ষমতাকে সর্বশ্রেষ্ঠতা বলে প্রতিপন্ন করলে সদ্গতির পথ একেবারে আটে-ঘাটে বন্ধ করা হয়।

 সর্বাঙ্গীণ মনুষ্যত্বের প্রতি যদি আমাদের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস থাকে তা হলে এত কথা ওঠে না। তা হলে কৌশলসাধ্য ব্যাখ্যা দ্বারা আপনাকে ভুলিয়ে কতকগুলো সংকীর্ণ বাহ্য সংস্কারের মধ্যে আপনাকে বদ্ধ করার প্রবৃত্তিই হয় না।

২৭