পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/১৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

N & R রবীন্দ্র-রচনাবলী কত দুঃখ কত বিচ্ছেদের ভিতর দিয়ে কত যত্নে একে এতকাল অগিলে এসেছেন, আমি সমস্ত দায় একেবারে ঘুচিয়ে দিয়ে যদি কলকাতায় চলে যাই তবে যে আমাকে অভিশাপ লাগবে এই কথাই বার বার আমার মনে হতে লাগল। দিদিশা গুড়ীর শূন্ত আসন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই সাধ্বী আট বছর বয়সে এই ঘরে এসেছেন, আর উনআশি বছরে মারা গেছেন । তার স্বখের জীবন ছিল না । ভাগ্য তার বুকে একটার পর একটা কত বাণই হেনেছে কিন্তু প্রত্যেক আঘাতেই তার জীবন থেকে অমৃত উছলে উঠেছে। এই বৃহৎ সংসার সেই চোখের জলে গলানো পুণ্যের ধারায় পবিত্র। এ ছেড়ে আমি কলকাতার জঞ্জালের মধ্যে গিয়ে কী করব ? আমার স্বামী মনে করেছিলেন এই সুযোগে আমার ছুই জায়ের উপর এখানকার সংসারের কর্তৃত্ব দিয়ে গেলে তাতে তাদের মনেও সান্তনা হত আর আমাদেরও জীবনটা কলকাতায় একটু ডালপালা মেলবার জায়গা পেত। আমার ওইখানেই গোল বেধেছিল । ওঁরা যে এতদিন আমাকে হাড়ে হাড়ে জালিয়েছেন,—আমার স্বামীর ভালো ওঁরা কখনো দেখতে পারেন নি । আজি কি তারই পুরস্কার পাবেন ? { } আর রাজসংসার তো এইখানেই । আমাদের সমস্ত প্রজা-আমলা, আশ্রিতভ্যাগত-আত্মীয় সমস্তই এখানকার এই বাড়িকে চারিদিকে আঁকড়ে । কলকাতায় আমরা কে তা জানি নে, অন্ত কজন লোকই বা জানে ? অামাদের মান-সন্মানঐশ্বর্ষের পূর্ণ মূর্তিই এখানে । এ-সমস্ত ওঁদের হাতে দিয়ে সীতা যেমন নিবাসনে গিয়েছিলেন তেমনি ক'রে চলে যাব ? অার ওঁরা পিছন থেকে হাসবেন ? ওঁরা কি আমার স্বামীর এ দাক্ষিণ্যের মর্যাদা বোঝেন, না তার যোগ্য ওঁরা ? তার পরে যখন কোনোদিন এখানে ফিরে আসতে হবে তখন আমার আসনটি কি আর ফিরে পাব ? আমার স্বামী বলতেন, দরকার কী তোমার ওই আসনের ? ও ছাড়াও তো জীবনের আরও অনেক জিনিস আছে—তার দাম অনেক বেশি । আমি মনে মনে বললুম, পুরুষমানুষ এ-সব কথা ঠিক বোঝে না। সংসারটা ষে কতখানি তা ওদের সম্পূর্ণ জানা নেই–সংসারের বাহির-মহলে যে ওদের বাস। এ জায়গায় মেয়েদের বুদ্ধিমতেই ওদের চলা উচিত । ... ' সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে একটা তেজ থাকা চাই তো । যারা চিরদিন এমন শক্ৰতা করে এসেছেন তাদের হাতে সমস্ত দিয়ে-থুরে চলে যাওয়া ষে পরাভৰ। আমার স্বামী যদি বা তা মানতে চান আমি তো মানতে দিতে পারব না। আমি মনে মনে জানলুম এ আমার সতীত্বের তেজ ।