পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে Re(t অপরাধ ? পৃথিবীতে যা সব-চেয়ে বড়ো তার এতই অনাদর ? হৃদয়ের পূজাকে কি পথের কুকুরের মতো দরজার বাইরে থেকে থেদিয়ে দিতে হবে, মঙ্গীরানী ? আমার বুকের মধ্যে দুরদুর করতে লাগল। বিপদ ক্রমশই কাছে ঘনিয়ে আসছে, আর তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আমার মনের মধ্যে পুলক আর ভয় দুইই সমান হয়ে উঠল । এই সর্বনাশের বোঝা আমি আমার পিঠ দিয়ে সামলাব কী করে ? আমাকে ষে পথের ধুলোর উপর মুখ থুবড়ে পড়তে হবে । আমার হাতপ কঁপিছিল । আমি খুব শক্ত হয়ে দাড়িয়ে তাকে বললুম, সন্দ্বীপবাবু, আপনি দেশের কী কাজ আছে বলে আমাকে ডেকেছেন, তাই আমার ঘরের কাজ ফেলে এসেছি । তিনি একটু হেসে বললেন, আমি তো সেই কথাই আপনাকে বলছিলুম। আমি যে পূজার জন্যেই এসেছি, তা জানেন ? আপনার মধ্যে আমি আমার দেশের শক্তিকেই প্রত্যক্ষ দেখতে পাই সে-কথা কি আপনাকে বলি নি ? ভূগোলবিবরণ তো একটা সত্য বস্তু নয়—শুধু সেই ম্যাপটার কথা স্মরণ করে কি কেউ জীবন দিতে পারে ? যখন আপনাকে সামনে দেখতে পাই তখনই তো বুঝতে পারি, দেশ কত সুন্দর, কত প্রিয়, প্রাণে তেজে কত পরিপূর্ণ ! আপনি নিজের হাতে আমার কপালে জয়টক পরিয়ে দেবেন তবেই তো জানব আমি আমার দেশের আদেশ পেয়েছি, তবেই তো সেই কথা স্বরণ করে লড়তে লড়তে মৃত্যুবাণ খেয়ে যদি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি তবে বুঝব সে কেবলমাত্র ভূগোলবিবরণের মাটি নয়, সে একখানা আঁচল— কেমন আঁচল জানেন ? আপনি সেদিন যে একখানি শাড়ি পরেছিলেন, লাল মাটির মতো তার রং, আর তার চওড়া পাড় একটি রক্তের ধারার মতো রাঙা, সেই শাড়ির আঁচল,—সে কি আমি কোনোদিন ভুলতে পারব ! এই সব জিনিসই ভো জীবনকে সতেজ, মৃত্যুকে রমণীয় করে তোলে। 曲 বলতে বলতে সম্বীপের দুই চোখ জলে উঠল । চোখে সে ক্ষুধার আগুন কি পূজার সে আমি বুঝতে পারলুম না। আমার সেই দিনের কথা মনে পড়ল ষেদিন আমি প্রথম ওঁর বক্তৃতা শুনেছিলুম। সেদিন, তিনি অগ্নিশিখা না মানুষ সে আমি তুলে গিয়েছিলুম। সাধারণ মামুষের সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করা চলে—তার অনেক কায়দা-কাকুন আছে ; কিন্তু আগুন যে আর-এক জাতের,সে একনিমেষে চোখে ধাধা লাগিয়ে দেয়, প্ৰলয়কে মুন্দর করে তোলে। মনে হতে থাকে, যে-সত্য প্রতিদিনের শুকনো কাঠে হেলাফেলার মধ্যে লুকিয়ে ছিল, সে জজ আপনার দীপ্যমান মূর্তি ধরে চারিদিকের সমস্ত কৃপণের সঞ্চয়গুলোকে অট্টহাস্তে দগ্ধ করতে ছুটে চলেছে।