পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8tசழு রবীন্দ্র-রচনাবলী দেখা দেয়। কিংবা খণ্ড খণ্ড আভাসকে কল্পনাশক্তির দ্বারা জুড়ে এক করে গড়ে তুলতে হয়। অস্তর-রাজ্যও বড়ো জটিল হয়ে পড়েছে, পথও বড়ো গোপন । ষাকে ইংরেজিতে ইনম্পাইরেশন বলে সে একটা মুগ্ধ অবস্থা ; তখন লেখক একটা অধচেতন শক্তির প্রভাবে কৃত্রিমজগতের শাসন অনেকটা অতিক্রম করে এবং মন্থন্মরাজার যেখানে খাসদরবার সেই মর্মসিংহাসনের সামনে গিয়ে উপস্থিত হয় । কিন্তু নিজের স্বখদু:খের দ্বারাই হ’ক, আর অন্তের সুখদুঃখের দ্বারাই হ’ক, প্রকৃতির বর্ণনা করেই হ’ক আর মনুষ্যচরিত্র গঠিত করেই হ’ক মানুষকে প্রকাশ করতে হবে। আর-সমস্ত উপলক্ষ্য । প্রকৃতিবর্ণনাও উপলক্ষ্য, কারণ, প্রকৃতি ঠিকটি কিরূপ তা নিয়ে সাহিত্যের কোনো মাথাব্যথাই নেই—কিন্তু প্রকৃতি মানুষের হৃদয়ে, মানুষের স্থখছুঃখের চারিদিকে কী রকম ভাবে প্রকাশিত হয় সাহিত্য তাই দেখায়। এমন কি, ভাষা তা ছাড়া আর কিছু পারে না। চিত্রকর যে-রং দিয়ে ছবি আঁকে সে-রঙের মধ্যে মানুষের জীবন মিশ্রিত হয় নি—কিন্তু কবি যে-ভাষা দিয়ে বর্ণনা করে তার প্রত্যেক শব্দ আমাদের হৃদয়ের দোলায় লালিতপালিত হয়েছে। তার মধ্যে থেকে সেই জীবনের মিশ্রণটুকু বাদ দিয়ে ভাষাকে জড় উপাদানে পরিণত করে নিছক বর্ণনাটুকু করে গেলে যে কাব্য হয় এ-কথা কিছুতে স্বীকার করা যায় না। সৌন্দর্যপ্রকাশও সাহিত্যের উদ্দেশ্য নয়, উপলক্ষ্য মাত্র । হামলেটের ছবি সৌন্দর্ষের ছবি নয়, মানবের ছবি—ওথেলোর অশাস্তি স্বন্দর নয়, মানবস্বভাবগত । কিন্তু সৌন্দর্য কী গুণে সাহিত্যে স্থান পায় বলা আবশ্যক। প্রকৃতির সৌন্দর্ধের সঙ্গে মানবহৃদয়ের একটা নিত্য মিশ্রণ আছে। তার মধ্যে প্রকৃতির জিনিস যতটা আছে তার চেয়ে মানবের চিত্ত বেশি। এইজন্তে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে মানব আপনাকেই অনুভব করে। প্রকৃতির সৌন্দর্য সম্বন্ধে যতই সচেতন হব, প্রকৃতির মধ্যে আমারই হৃদয়ের ব্যাপ্তি তত বাড়বে। কিন্তু কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যই তো কবির বর্ণনার বিষয় নয়। প্রকৃতির ভীষণত্ব, প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা সে তো বর্ণনীয়। কিন্তু সেও আমাদের হৃদয়ের জিনিস, প্রকৃতির জিনিস নয়। অতএব, এমন কোনো বর্ণনা সাহিত্যে স্থান পেতে পারে না, বা স্বনার নয়, শাস্তিময় নয়, ভীষণ নয়, মহৎ নয়, যার মধ্যে মানবধর্ম নেই কিংবা যা অভ্যাস বা অন্ত কারণে মানবের সঙ্গে নিকটসম্পর্কে বদ্ধ নয় । আমার বোধ হচ্ছে আমার প্রথম চিঠিতে লেখকেরই নিজৰ প্রকাশের উপর এতটা ক্টোক দিয়েছিলুম যে, সেইটেই সাহিত্যের মূল লক্ষ্য এই রকম বুঝিয়ে গেছে।