পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 dbr রবীন্দ্র-রচনাবলী রামসুন্দর বলিলেন, “ছি মা, অমন কথা বলতে নেই। আর এ টাকাটা যদি আমি না দিতে পারি তা হলে তোর বাপের অপমান আর তোরও অপমান ।” নিরু কহিল, “টাকা। যদি দাও। তবেই অপমান । তোমার মেয়ের কি কোনো মর্যাদা নেই। আমি কি কেবল একটা টাকার থলি, যতক্ষণ টাকা আছে ততক্ষণ আমার দাম । না বাবা, এ টাকা দিয়ে তুমি আমাকে অপমান কোরো না । তা ছাড়া আমার স্বামী তো এ টাকা চান না ।” রামসুন্দর কহিলেন, “তা হলে তোমাকে যেতে দেবে না, মা ।” । নিরুপমা কহিল, “না দেয় তো কী করবে বলে । তুমিও আর নিয়ে যেতে চেয়ে না।” রামসুন্দর কম্পিত হন্তে নোটবাঁধা চাদরটি কাধে তুলিয়া আবার চোরের মতো সকলের দৃষ্টি এড়াইয়া বাড়ি ফিরিয়া গেলেন । কিন্তু রামসুন্দর এই-যে টাকা আনিয়াছিলেন এবং কন্যার নিষেধে সে টাকা না দিয়াই চলিয়া গিয়াছেন, সে কথা গোপন রহিল না । কোনো স্বভাবকীেতুহলী দ্বারলগ্নকৰ্ণ দাসী নিরুর শাশুড়িকে এই খবর দিল । শুনিয়া তাহার। আর আক্রোশের সীমা রহিল না । নিরুপমার পক্ষে তাহার শ্বশুরবাড়ি শরশয্যা হইয়া উঠিল । এ দিকে তাহার স্বামী বিবাহের অল্পদিন পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হইয়া দেশান্তরে চলিয়া গিয়াছে ; এবং পাছে সংসৰ্গদোষে হীনতা শিক্ষা হয়, এই ওজরে সম্প্রতি বাপের বাড়ির আত্মীয়দের সহিত নিরুর সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হইয়াছে। : এই সময়ে নিরুর একটা গুরুতর পীড়া হইল। কিন্তু সেজন্য তাহার শাশুড়িকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না । শরীরের প্রতি সে অত্যন্ত অবহেলা করিত । কার্তিক মাসের হিমের সময় সমস্ত রাত মাথার দরজা খোলা, শীতের সময় গায়ে কাপড় নাই । আহারের নিয়ম নাই। দাসীরা যখন মাঝে মাঝে খাবার আনিতে ভুলিয়া যাইত তখন যে তাঁহাদের একবার মুখ খুলিয়া স্মরণ করাইয়া দেওয়া, তাহাও সে করিত না । সে-যে পরের ঘরের দাসদাসী এবং কর্তাগৃহিণীদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করিয়া বাস করিতেছে, এই সংস্কার তাহার মনে বদ্ধমূল হইতেছিল। কিন্তু এরূপ ভাবাটাও শাশুড়ির সহ্য হইত না। যদি আহারের প্রতি বধুর কোনো অবহেলা দেখিতেন, তবে শাশুড়ি বলিতেন, “নবাবের বাড়ির মেয়ে কিনা । গরিবের ঘরের অন্ন ওঁর মুখে রোচে না ।” কখনো-বা বলিতেন, “দেখে-না একবার, ছিরি হচ্ছে দেখো-না, দিনে দিনে যেন পোড়াকাঠি হয়ে যাচ্ছে ।” রোগ যখন গুরুতর হইয়া উঠিল তখন শাশুড়ি বলিলেন, “ওঁর সমস্ত ন্যাকামি ।” অবশেষে একদিন নিরু সবিনয়ে শাশুড়িকে বলিল, “বাবাকে আর আমার ভাইদের একবার দেখব, মা ।” শাশুড়ি বলিলেন, “কেবল বাপের বাড়ি যাইবার ছিল ।” কেহ বলিলে বিশ্বাস করিবে না- যেদিন সন্ধ্যার সময় নিরুর শ্বাস উপস্থিত হইল, সেইদিন প্রথম ডাক্তার দেখিল, এবং সেইদিন ডাক্তারের দেখা শেষ হইল । বাড়ির বড়োবউ মরিয়াছে, খুব ধুম করিয়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হইল। প্ৰতিমা বিসর্জনের সমারোহ সম্বন্ধে জেলার মধ্যে রায়চৌধুরিদের যেমন লোকবিখ্যাত প্ৰতিপত্তি আছে, বড়োবউয়ের সৎকার সম্বন্ধে রায়বাহাদুরদের তেমনি একটা খ্যাতি রাটিয়া গেলা— এমন চন্দনকাষ্ঠের চিতা এ মুলুকে কেহ কখনো দেখে নাই। এমন ঘটা করিয়া শ্ৰাদ্ধও কেবল রায়বাহাদুরদের বাড়িতেই সম্ভব এবং শুনা যায়, ইহাতে তাহাদের কিঞ্চিৎ ঋণ হইয়াছিল । রামসুন্দরকে সাস্তুনা দিবার সময় তাহার মেয়ের যে কিরূপ মহাসমারোহে মৃত্যু হইয়াছে, সকলেই তাহার বহুল বর্ণনা করিল। এ দিকে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের চিঠি আসিল, “আমি এখানে সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছি, অতএব অবিলম্বে আমার স্ত্রীকে এখানে পাঠাইবে ।” রায়বাহাদুরের মহিষী লিখিলেন, “বাবা, তোমার জন্যে আর-একটি মেয়ের সম্বন্ধ করিয়াছি, অতএব অবিলম্বে ছুটি লইয়া এখানে আসিবে ।” এবারে বিশ হাজার টাকা পণ এবং হাতে হাতে আদায় । S R&br ?