পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ (* ঘরের লোকের কাছে তারাপ্রসক্সের ভাব অন্যরূপ ; এমন-কি, তাহার নিজের স্ত্রী দাক্ষায়ণীও তাহার সহিত কথায় আঁটিয়া উঠিতে পারেন না। গৃহিণী কথায় কথায় বলেন, “নেও নেও, আমি হার মানলুম। আমার এখন অন্য কাজ আছে।” বাগযুদ্ধে স্ত্রীকে আত্মমুখে পরাজয় স্বীকার করাইতে পারে, এমন ক্ষমতা এবং এমন সৌভাগ্য কয়জন স্বামীর আছে । তারাপ্ৰসন্নের দিন বেশ কাটিয়া যাইতেছে। দাক্ষায়ণীর দৃঢ় বিশ্বাস, বিদ্যাবুদ্ধি-ক্ষমতায় তাহার স্বামীর সমতুল্য কেহ নাই এবং সে কথা তিনি প্রকাশ করিয়া বলিতেও কুষ্ঠিত হইতেন না ; শুনিয়া তারাপ্ৰসন্ন বলিতেন, “তোমার একটি বৈ স্বামী নাই, তুলনা কাহার সহিত করিবে।” শুনিয়া দাক্ষায়ণী ভারি রাগ করিতেন । দাক্ষায়ণীর কেবল একটা এই মনস্তাপ ছিল যে, তাহার স্বামীর অসাধারণ ক্ষমতা বাহিরে প্রকাশ হয় নাস্বামীর সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র চেষ্টা নাই। তারাপ্ৰসন্ন যাহা লিখিতেন তাহা ছাপাইতেন না । অনুরোধ করিয়া দাক্ষায়ণী মাঝে মাঝে স্বামীর লেখা শুনিতেন, যতই না বুঝিতেন ততই আশ্চর্য হইয়া যাইতেন । তিনি কৃত্তিবাসের রামায়ণ কাশীদাসের মহাভারত, কবিকঙ্কণ-চণ্ডী পড়িয়াছেন এবং কথকতাও শুনিয়াছেন । সে-সমস্তই জলের মতো বুঝা যায়, এমন-কি, নিরক্ষর লোকেও অনায়াসে বুঝিতে পারে, কিন্তু র্তাহার স্বামীর মতো এমন সম্পূর্ণ দুর্বোিধ হইবার আশ্চর্য ক্ষমতা তিনি ইতিপূর্বে কোথাও দেখেন নাই । তিনি মনে মনে কল্পনা করিতেন, এই বই যখন ছাপানো হইবে এবং কেহ এক অক্ষর বুঝিতে পরিবে না, তখন দেশসুদ্ধ লোক বিস্ময়ে কিরূপ অভিভূত হইয়া যাইবে । সহস্রাবার করিয়া স্বামীকে বলিতেন, “এ-সব লেখা ছাপাও ।” স্বামী বলিতেন, “বই ছাপানো সম্বন্ধে ভগবান মনু স্বয়ং বলে গেছেন ঃ প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলা ।” তারাপ্রসনের চারিটি সন্তান, চারই কন্যা । দীক্ষায়ণী মনে করিতেন সেটা গৰ্ভধারিণীরই অক্ষমতা । এইজন্য তিনি আপনাকে প্রতিভাসম্পন্ন স্বামীর অত্যন্ত অযোগ্য স্ত্রী মনে করিতেন। যে স্বামী কথায় কথায় এমন-সকল দুরূহ গ্ৰন্থ রচনা করেন, তাহার স্ত্রীর গর্ভে কন্যা বৈ আর সস্তান হয় না, স্ত্রীর পক্ষে এমন অপটুতার পরিচয় আর কী দিব । প্রথম কন্যাটি যখন পিতার বক্ষের কাছ পর্যন্ত বাড়িয়া উঠিল, তখন তারাপ্রসনের নিশ্চিন্তাভাব ঘুচিয়া গেল । তখন তাহার স্মরণ হইল, একে একে চারিটি কন্যারই বিবাহ দিতে হইবে, এবং সেজন্য বিস্তর অর্থের প্রয়োজন । গৃহিণী অত্যন্ত নিশ্চিন্তমুখে বলিলেন, “তুমি যদি একবার একটুখানি মন দাও, তাহা হইলে ভাবনা किछुछ्रे नाश् ।” তারাপ্ৰসন্ন কিঞ্চিৎ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “সত্য নাকি । আচ্ছা, বিলো দেখি কী করিতে হইবে ।” দীক্ষায়ণী সংশয়শূন্য নিরুদবিগ্নভাবে বলিলেন, “কলিকাতায় চলো, তোমার বইগুলা ছাপাও, পাচজন লোকে তোমাকে জানুক- তার পরে দেখো দেখি, টাকা। আপনি আসে কি না ।” স্ত্রীর আশ্বাসে তারাপ্ৰসন্ন্যও ক্ৰমে আশ্বাস লাভ করিতে লাগিলেন এবং মনে প্ৰত্যয় হইল, তিনি ইস্তক-নাগাদ বসিয়া বসিয়া যত লিখিয়াছেন তাহাতে পাড়াসুদ্ধ লোকের কন্যাদায় মোচন হইয়া যায় । এখন, কলিকাতায় যাইবার সময় ভারি গোল পড়িয়া গেল । দীক্ষায়ণী তাহার নিরুপায় নিঃসহায় সযত্নপালিত স্বামীটিকে কিছুতেই একলা ছাড়িয়া দিতে পারেন না। র্তাহাকে খাওয়াইয়া পরাইয়া নিত্যনৈমিত্তিক কর্তব্য স্মরণ করাইয়া সংসারের বিবিধ উপদ্রব হইতে কে রক্ষা করিবে । কিন্তু অনভিজ্ঞ স্বামীও অপরিচিত বিদেশে স্ত্রীকন্যা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে অত্যন্ত ভীত ও অসম্মত । অবশেষে দাক্ষায়ণী পাড়ার একটি চতুর লোককে স্বামীর নিত্য-অভ্যাস সম্বন্ধে সহস্র উপদেশ দিয়া আপনার পদে নিযুক্ত করিয়া দিলেন । এবং স্বামীকে অনেক মাথার দিব্য ও অনেক মাদুলিতাগায় আচ্ছন্ন করিয়া বিদেশে রওনা করিয়া দিলেন । এবং ঘরে আছড়ে খাইয়া কঁাদিতে লাগিলেন । কলিকাতায় আসিয়া তারা প্ৰসন্ন তাহার চতুর সঙ্গীর সাহায্যে ‘বেদান্তপ্রভাকর প্রকাশ করিলেন । দাক্ষায়ণীর গহনা বন্ধক রাখিয়া যে টাকাকাটি পাইয়াছিলেন তাহার অধিকাংশই খরচ হইয়া গেল । Vrvoео