পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(? Abr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী চিত্রকার নিজের সদ্যসমাপ্ত ছবি ঈষৎ দূর হইতে যেমন করিয়া দেখে তেমনি করিয়া সস্নেহে সহস্যে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিত ; কোনো কোনো দিন মৌখিক ঝগড়াও করিত, ছল করিয়া ভৎসনা করিত, আমিনাকে গৃহে রুদ্ধ করি যা যুবকের মিলনাবেগ প্রতিহত করিত । সম্রাট এবং আরণ্যের মধ্যে একটা সাদৃশ্য আছে। উভয়ে স্বাধীন, উভয়েই স্বরাজ্যের একাধিপতি, উভয়কেই কাহারও নিয়ম মানিয়া চলিতে হয় না। উভয়ের মধ্যেই প্রকৃতির একটা স্বাভাবিক বৃহত্ত্ব এবং কিছু স্বতন্ত্র গোছের হয় ! তাহারাই বড়োর কাছে দাস, ছোটাের কাছে প্ৰভু এবং অস্থানে নিতান্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দাঁড়ায় । বর্বর দালিয়া প্রকৃতি-সম্রাজ্ঞীর উচ্ছঙ্খল ছেলে, শাহজাদীর কাছে কোনো সংকোচ ছিল না, এবং শাহজাদীরাও তাহাকে সমকক্ষ লোক বলিয়া চিনিতে পারিত । সহস্য, সরল, কৌতুকপ্রিয়, সকল অবস্থাতেই নিভীক, অসংকুচিত তাহার চরিত্রে দারিদ্র্যের কোনো লক্ষণই ছিল না । কিন্তু এই সকল খেলার মধ্যে এক-একবার জুলিখার হৃদয়টা হায়-হায় করিয়া উঠিত ; ভাবিত, সম্রাটপুত্রীর জীবনের এই কি পরিণাম । একদিন প্ৰাতে দালিয়া আসিবামাত্র জুলিখা তাহার হাত চাপিয়া কহিল, “দালিয়া, এখানকার রাজাকে দেখাইয়া দিতে পাের ?” “পারি । কেন বলো দেখি ।” “আমার একটা ছোরা আছে, তাহার বুকের মধ্যে বসাইতে চাই ।” প্রথমে দালিয়া কিছু আশ্চর্য হইয়া গেল। তাহার পরে জুলিখার হিংসাপ্রখর মুখের দিকে চাহিয়া তাহার সমস্ত মুখ হাসিতে ভরিয়া গেল ; যেন এতবড়ো মজার কথা সে ইতিপূর্বে কখনো শোনে নাই। — যদি পরিহাস বলো তো এই বটে, রাজপুত্রীর উপযুক্ত । কোনো কথা নাই, বার্তা নাই, প্রথম আলাপেই একখানি ছোরার আধখানা একটা জীবন্ত রাজার বক্ষের মধ্যে চালনা করিয়া দিলে এইরূপ অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ব্যবহারে রাজাটা হঠাৎ কিরূপ অবাক হইয়া যায়, সেই চিত্র ক্রমাগত তাহার মনে উদিত হইয়া তাহার নিঃশব্দ কৌতুকহাসি থাকিয়া থাকিয়া উচ্চহাস্যে পরিণত হইতে লাগিল । পঞ্চম পরিচ্ছেদ তাহার পরদিনই রহমত শেখ জুলিখাকে গোপনে পত্র লিখিল যে, “আরাকানের নূতন রাজা ধীবরের কুটিরে দুই ভগ্নীর সন্ধান পাইয়াছেন এবং গোপনে আমিনাকে দেখিয়া অত্যন্ত মুগ্ধ হইয়াছেন— তাহাকে বিবাহাৰ্থে অবিলম্বে প্রাসাদে আনিবার আয়োজন করিতেছেন। প্ৰতিহিংসার এমন সুন্দর অবসর আর পাওয়া যাইবে না ?” তখন জুলিখা দৃঢ়ভাবে আমিনার হাত ধরিয়া কহিল, ঈশ্বরের ইচ্ছা স্পষ্টই দেখা যাইতেছে। আমিনা, এইবার তোর জীবনের কর্তব্য পালন করিবার সময় আসিয়াছে- এখন আর খেলা ভালো দেখায় না ।” দালিয়া উপস্থিত ছিল, আমিন তাহার মুখের দিকে চাহিল ; দেখিল সে সকৌতুকে হাসিতেছে। আমিন তাহার হাসি দেখিয়া মর্মাহত হইয়া কহিল, “জান দালিয়া ?— আমি রাজবধু হইতে যাইতেছি।” দালিয়া হাসিয়া বলিল, “সে তো বেশিক্ষণের জন্য নয় ।” আমিনা পীড়িত বিস্মিত চিত্তে মনে মনে ভাবিল, “বাস্তবিকই এ বনের মৃগ, এর সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করা আমারই পাগলামি ।’ শুনি পালিয়াকে আর একটু সচেতন করিয়া তুলিবার জন্য কহিল, আজকে মারিয়া আর কি আমি রব ।” দালিয়া কথাটা সংগত জ্ঞান করিয়া কহিল, “ফেরা কঠিন বটে । আমিনার সমস্ত অন্তরাত্মা একেবারে স্নান হইয়া গেল ।