পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন (*6ł কিন্তু এই একটি অত্যন্ত আশ্চর্য ব্যাপার, মানুষ প্রকাশ্যের চেয়ে গোপনকে কিছুমাত্র কম করে চায় নাএমন-কি, বেশি করেই চায় । তার সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ের বিরুদ্ধ সুক্ষ্য সত্ত্বেও মানুষ বলেছে, “দেখতে পাচ্ছি নে কিন্তু আরো আছে, শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু আরো আছে।” জগতে অনেক গুপ্ত সামগ্ৰী আছে যার আচ্ছাদন তুলে ফেললেই তা প্ৰত্যক্ষগম্য হয়ে ওঠে, এ কিন্তু সেরকম নয়- এ আচ্ছন্ন বলে গুপ্ত নয়, এ গভীর বলেই গুপ্ত, সুতরাং একে যখন আমরা জানতে পারি তখনো এ গভীর থাকে । গোরু উপরের থেকে ঘাস ছিড়ে খায়, শূকর দাঁত দিয়ে মাটি চিরে সেই ঘাসের মুথ উপড়ে খেয়ে থাকে, কিন্তু এখানে উপরের ঘাসের সঙ্গে নিচেকার মুথার প্রকৃতিগত কোনো প্ৰভেদ নেই, দুটিই স্পর্শগম্য এবং দুটিতেই সমানরকমেই পেট ভরে । কিন্তু মানুষ গোপনের মধ্যে যা খুঁজে বের করে, প্রকাশ্যের সঙ্গে তার যোগ আছে- সাদৃশ্য নেই । তা খনির ভিতরকার খনিজের মতো তুলে এনে ভাণ্ডার বোঝাই করবার জিনিস নয় । অথচ মানুষ তাকে রত্বের চেয়ে বেশি মূল্যবান রত্ন বলেই জানে । তার মানে আর-কিছুই নয়, মানুষের একটি অন্তরতর ইন্দ্ৰিয় আছে- তার ক্ষুধাও অন্তরতর, তার খাদ্যও অন্তরতর, তার তৃপ্তিও অন্তরতর } এইজন্যই চিরকাল মানুষ চোখের দেখাকে ভেদ করবার জন্যে একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এইজনা মানুষ, আকাশে তারা আছে, কেবল এইটুকুমাত্র দেখেই মাটির দিকে চােখ ফেরায় নি- এইজন্যে কোন সুদূর অতীতকালে ক্যালডিয়ার মরুপ্রান্তরে মেষপালক মেষ চরাতে চরাতে নিশীথরাত্রের আকাশপৃষ্ঠায় জ্যোতিষ্করহস্য পাঠ করে নেবার জন্যে রাত্রের পরে রাত্রে অনিমেষ নিদ্রাহীন নোত্রে যাপন করেছে- তাদের যে মেষরা চারছিল তার মধ্যে কেহই একবারও সেদিকে তাকাবার প্রয়োজনমাত্র অনুভব করে নি । কিন্তু মানুষ যা দেখে তার গুহাহিত দিকটাও দেখতে চায়, নইলে সে কিছুতেই স্থির হতে পারে না । এই অগোচরের রাজ্য অন্বেষণ করতে করতে মানুষ যে কেবল সত্যকেই উদঘাটন করেছে, তা বলতে পারি। নে । কত ভ্ৰমের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, তার সীমা নেই । গোচরের রাজ্যে ইন্দ্ৰিয়ের সাহায্যেও সে প্ৰতিদিন এককে আর বলে দেখে, কত ভুলকেই তার কাটিয়ে উঠতে হয় তার সীমা নেই, কিন্তু তাই বলে প্ৰত্যক্ষের ক্ষেত্ৰকে তো একেবারে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না । তেমনি অগোচরের দেশেও যেখানে আমরা গোপনকে খুঁজে বেড়াই, সেখানে আমরা অনেক ভ্রমকে যে সত্য বলে গ্রহণ করেছি। তাতে সন্দেহ নেই। একদিন বিশ্বব্যাপারের মূলে আমরা কত ভূতপ্ৰেত কত অদ্ভুত কাল্পনিক মূর্তিকে দাড় করিয়েছি তার ঠিকানা নেই, কিন্তু তাই নিয়ে মানুষের এই মনোবৃত্তিটিকে উপহাস করবার কোনো কারণ দেখি নে । গভীর জলে জাল ফেলে যদি পাক ও গুগলি ওঠে, তার থেকেই জালাফেলাকে বিচার করা চলে না | মানুষ তেমনি অগোচরের তলায় যে জাল ফেলেছে, তার থেকে এ পর্যন্ত পাক বিস্তর উঠেছে- কিন্তু তবুও তাকে অশ্রদ্ধা করতে পারি নে। সকল দেখার চেয়ে বেশি দেখা, সকল পাওয়ার চেয়ে বেশি পাওয়ার দিকে মানুষের এই চেষ্টাকে নিয়ত প্রেরণ করা, এইটেই একটি আশ্চর্য ব্যাপার- আফ্রিকার বন্যবর্বরতার মধ্যেও যখন এই চেষ্টার পরিচয় পাই, তখন তাদের অদ্ভুত বিশ্বাস এবং বিকৃত কদাকার দেবমূর্তি দেখেও মানুষের এই অন্তনিহিত শক্তির একটি বিশেষ গৌরব অনুভব না করে থাকা যায় না । মানুষের এই শক্তিটি সত্য- এবং এই শক্তিটি সত্যকেই গোপনতা থেকে উদ্ধার করবার এবং মানুষের চিত্তকে গভীরতার নিকেতনে নিয়ে যাবার জন্যে । . 『. এই শক্তিটি মানুষের এত সত্য যে, একে জয়যুক্ত করবার জন্যে মানুষ দুৰ্গমতার কোনো বাধাকেই মানতে চায় না । এখানে সমুদ্র-পর্বতের নিষেধ মানুষের কাছে ব্যর্থ হয়, এখানে ভয় তাকে ঠেকাতে পারে না, রংবার নিম্বফলতা তার গতিরোধ করতে পারে না- এই শক্তির প্রেরণায় মানুষ তার সমস্ত ত্যাগ করে এবং অনায়াসে প্ৰাণ বিসর্জন করতে পারে । মানুষ যে দ্বিজ ; তার জন্মক্ষেত্র দুই জায়গায় । এক জায়গায় সে প্রকাশ্য, আর-এক জায়গায় সে গুহাহিত, সে গভীর। এই বাইরের মানুষটি বেঁচে থাকবার জন্যে চেষ্টা করছে, সেজন্যে তাকে চতুর্দিকে কত ংগ্ৰহ কত সংগ্ৰাম করতে হয় ; তেমনি আবার ভিতরকার মানুষটিও বেঁচে থাকবার জন্যে লড়াই করে