পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন G&S এইখানেই মানুষ সেই মহৎ তত্ত্বটি আবিষ্কার করেছে যে, উপস্থিত যা তার চারিদিকেই আছে সেই পিঞ্জরটার মধ্যেই মানুষ সম্পূর্ণ নয়, মানুষ আপনার বর্তমানের চেয়ে অনেক বড়ো- এইজন্যে কোনো একটা জায়গায় দাড়িয়ে থাকলে তার আরাম হতে পারে, কিন্তু তার চরিতার্থতা তাতে একেবারে বিনষ্ট হয় । সেই মহতী বিনষ্টিকে মানুষ সহ্য করতে পারে না । এইজন্যই, তার বর্তমানকে ভেদ করে বড়ো হবার জন্যই, এখনো সে যা হয়ে ওঠে নি। তাই হতে পারবার জন্যেই, মানুষকে কেবলই বার বার দুঃখ পেতে হচ্ছে। সেই দুঃখের মধ্যেই মানুষের গৌরব । এই কথা মনে রেখে, মানুষ আপনার কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করে নি, কেবলই তাকে প্রসারিত করেই চলেছে। অনেক সময় এত দূর পর্যন্ত গিয়ে পড়েছে যে কর্মের সার্থকতাকে বিস্মৃত হয়ে ভয়ংকর আবর্ত রচনা করছে— স্বার্থের আবর্ত, সাম্রাজ্যের আবর্ত, ক্ষমতাভিমানের আবর্ত । কিন্তু, তবু যতক্ষণ গতিবেগ আছে ততক্ষণ ভয় নেই ; সংকীর্ণতার বাধা সেই গতির মুখে ক্রমশই কেটে যায়, কাজের বেগই কাজের ভুলকে সংশোধন করে । কারণ, চিত্ত অচল জড়তার মধ্যে নিদ্রিত হয়ে পড়লেই তার শক্ৰ প্ৰবল হয়ে ওঠে, বিনাশের সঙ্গে আর সে লড়াই করে উঠতে পারে না । বেঁচে থেকে কর্মকরতে হবে, কর্ম করে বেঁচে থাকতে হবে, এই অনুশাসন আমরা শুনেছি। কর্ম করা এবং বঁাচা, এই দুয়ের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য GRI5 V5(g | প্ৰাণের লক্ষণই হচ্ছে এই যে, আপনার ভিতরটাতেই তার আপনার সীমা নেই, তাকে বাইরে আসতেই হবে । তার সত্য- অন্তর এবং বাহিরের যোগে ! দেহকে বেঁচে থাকতে হয় বলেই বাইরের আলো, বাইরের বাতাস, বাইরের অন্নজলের সঙ্গে তাকে নানা যোগ রাখতে হয় । শুধু প্ৰাণশক্তিকে নেবার জন্যে নয়, তাকে দান করবার জন্যেও বাইরেকে দরকার । এই দেখে-না কেন, শরীরকে তো নিজের ভিতরের কাজ যথেষ্টই করতে হয় ; এক নিমেষও তার হৃৎপিণ্ড থেমে থাকে না, তার মস্তিষ্ক তার পাকযন্ত্রের কাজের অন্ত নেই ; তবু দেহটা নিজের ভিতরকার এই অসংখ্য প্রাণের কাজ করেও স্থির থাকতে পারে না— তার প্রাণই তাকে বাইরের নানা কাজে এবং নানা খেলায় ছুটিয়ে বেড়ায় । কেবলমাত্র ভিতরের রক্তচলাচলেই তার তুষ্টি নেই, নানা প্রকারে বাইরের চলাচলে তার আনন্দ সম্পূর্ণ হয় । আমাদের চিত্তেরও সেই দশা । কেবলমাত্র আপনার ভিতরের কল্পনা ভাবনা নিয়ে তার চলে না । বাইরের বিষয়কে সর্বদাই তার চাই- কেবল নিজের চেতনাকে বঁচিয়ে রাখবার জন্যে নয়, নিজেকে প্রয়োগ করবার জন্যে, দেবার জন্যে এবং নেবার জন্যে । আসল কথা, যিনি সত্যস্বরূপ সেই ব্ৰহ্মকে ভাগ করতে গেলেই আমরা বঁচি নে । তাকে অন্তরেও যেমন আশ্রয় করতে হবে বাইরেও তেমনি আশ্ৰয় করতে হবে । তাকে যে দিকে ত্যাগ করব সেই দিকে নিজেকেই বঞ্চিত করব । মাহং ব্ৰহ্ম নিরাকুর্যাং মা মা ব্ৰহ্ম নিরাকারোৎ | ব্ৰহ্ম আমাকে ত্যাগ করেন নি, আমি যেন ব্ৰহ্মকে ত্যাগ না করি । তিনি আমাকে বাহিরে ধরে রেখেছেন । তিনি আমাকে অন্তরেও জাগিয়ে রেখেছেন । আমরা যদি এমন কথা বলি যে, তাকে কেবল অস্তরের ধ্যানে পাব, বাইরের কর্ম থেকে তাকে বাদ দেবকেবল হৃদয়ের প্রেমের দ্বারা তাকে ভোগ করব, বাইরের সেবার দ্বারা তার পূজা করব না- কিংবা একেবারে এর উলটাে কথাটাই বলি, এবং এই বলে জীবনের সাধনাকে যদি কেবল এক দিকেই ভারগ্রস্ত করে তুলি তা হলে প্ৰমত্ত হয়ে আমাদের পতন ঘটবে। আমরা পশ্চিম মহাদেশে দেখছি সেখানে মানুষের চিত্ত প্ৰধানত বাহিরেই আপনাকে বিকীর্ণ করতে বসেছে। শক্তির ক্ষেত্রই তার ক্ষেত্র । ব্যাপ্তির রাজেই সে একান্ত কুঁকে পড়েছে, মানুষের অন্তরের মধ্যে যেখানে সমাপ্তির রাজ্য সে জায়গাটাকে সে পরিত্যাগ করবার চেষ্টায় আছে, তাকে সে ভালো করে বিশ্বাসই করে না। এত দূর পর্যন্ত গেছে যে সমাপ্তির পূর্ণতাকে সে কোনো জায়গাতেই দেখতে পায় না। যেমন বিজ্ঞান বলছে বিশ্বজগৎ কেবলই পরিণতির অন্তহীন পথে চলেছে, তেমনি য়ুরোপ আজকাল বলতে আরম্ভ করেছে- জগতে ঈশ্বরও ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠছেন । তিনি যে নিজে হয়ে আছেন এ তারা মানতে চায় না, তিনি নিজেকে করে তুলছেন এই তাদের কথা । ব্ৰহ্মের এক দিকে ব্যাপ্তি, আর-এক দিকে সমাপ্তি ; এক দিকে পরিণতি, আর-এক দিকে পরিপূর্ণতা ; এক brllያ©br