পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VeSGNo আমারই শান্তি ; মনে যেন না করি স্তব পাঠ করে, নামগান করে, কিছুক্ষণের জন্যে একটা ভাবের আনন্দ লাভ করে আমরা যথার্থীরাপে নববর্ষকে আমাদের জীবনের মধ্যে আবাহন করতে পেরেছি। জগতের মধ্যে এই মুহুর্তে যিনি নবপ্রভাতকে প্রেরণ করেছেন তিনি আজ নববর্ষকে আমাদের দ্বারে প্রেরণ করলেন, এই কথাটিকে সত্যরূপে মনের মধ্যে চিন্তা করে । একবার ধ্যান করে দেখো, আমাদের সেই নববর্ষের কী ভীষণ রূপ । তার অনিমেষ নোত্রের দৃষ্টির মধ্যে আগুন জ্বলছে । প্ৰভাতের এই শান্ত নিঃশব্দ সমীরণ সেই ভীষণের কঠোর আশীর্বাদকে অনুচ্চারিত বজ্ৰবাণীর মতো বহন করে এনেছে । মানুষের নববর্ষ আরামের নববর্ষ নয় ; সে এমন শান্তির নববর্ষ নয় ; পাখির গান তার গান নয়, অরুণের আলো তার আলো নয় । তার নববর্ষ সংগ্ৰাম করে আপনি অধিকার লাভ করে ; আবরণের আবরণকে ছিন্ন বিদীর্ণ করে তবে তার অভ্যুদয় ঘটে । বিশ্ববিধাতা সূর্যকে অগ্নিশিখার মুকুট পরিয়ে যেমন সৌরজগতের অধিরাজ করে দিয়েছেন, তেমনি মানুষকে যে তেজের মুকুট তিনি পরিয়েছেন দুঃসহ তার দাহ । সেই পরম দুঃখের দ্বারাই তিনি মানুষকে রাজগৌরব দিয়েছেন ; তিনি তাকে সহজ জীবন দেন নি। সেইজন্যেই সাধন করে তবে মানুষকে মানুষ করতে হয় ; তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, কিন্তু মানুষ প্ৰাণপণ চেষ্টায়। তবে মানুষ । তাই বলছি আজ যদি তিনি আমাদের জীবনের মধ্যে নববর্ষ পাঠিয়ে থাকেন তবে আমাদের সমস্ত শক্তিকে জাগ্রত করে তুলে তাকে গ্ৰহণ করতে হবে । সে তো সহজ দান নয়, আজ যদি প্ৰণাম করে তার সে দান গ্ৰহণ করি তবে মাথা তুলতে গিয়ে যেন কেঁদে না বলে উঠি ‘তোমার এ ভার বহন করতে পারি। নে প্ৰভু, মনুষ্যত্বের অতি বিপুল দায় আমার পক্ষে দুর্ভর । প্ৰত্যেক মানুষের উপরে তিনি সমস্ত মানুষের সাধনা স্থাপিত করেছেন, তাই তো মানুষের ব্ৰত এত কঠোর ব্ৰত । নিজের প্রয়োজনটুকুর মধ্যে কোনোমতেই তার নিস্কৃতি নেই। বিশ্বমানবের জ্ঞানের সাধনা, প্রেমের সাধনা, কর্মের সাধনা, মানুষকে গ্রহণ করতে হয়েছে। সমস্ত মানুষ প্ৰত্যেক মানুষের মধ্যে আপনাকে চরিতাৰ্থ করবে বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে । এইজন্যেই তার উপরে এত দাবি । এইজন্যে নিজেকে তার পদে পদে এত খর্ব করে চলতে হয় ; এত তার ত্যাগ, এত তার দুঃখ, এত তার আত্মসংবরণ । মানুষ যখনই মানুষের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে তখনই বিধাতা তাকে বলেছেন, “তুমি বীর ।” তখনই তিনি তার ললাটে জয়তিলক ঐকে দিয়েছেন । পশুর মতো আর তো সেই ললাটকে সে মাটির কাছে অবনত করে সঞ্চারণ করতে পারবে না ; তাকে বক্ষ প্রসারিত করে আকাশে মাথা তুলে চলতে হবে । তিনি মানুষকে আহবান করেছেন, “হে বীর, জাগ্রত হও । একটি দরজার পর আর-একটি দরজা ভাঙো, একটি প্রাচীরের পর আর-একটি পাষাণপ্রাচীর বিদীর্ণ করো। তুমি মুক্ত হও, আপনার মধ্যে তুমি বদ্ধ থেকে না। ভূমার মধ্যে তোমার প্রকাশ হোক ৷” এই-যে যুদ্ধে তিনি আমাদের আহবান করেছেন তার অন্ত্র তিনি দিয়েছেন । সে র্তার ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ ; সে শক্তি আমাদের আত্মার মধ্যে রয়েছে । আমরা যখন দুর্বলকণ্ঠে বলি, “আমার বল নেই, সেইটেই আমাদের মোহ । দুৰ্জয় বল আমার মধ্যে আছে। তিনি নিরস্ত্র সৈনিককে সংগ্রামক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিয়ে পরিহাস করবার জন্যে তার পরাভবের প্রতীক্ষা করে নেই। আমার অন্তরের অস্ত্রশালায় তঁর শানিত অস্ত্ৰ সব ঝক ঝক করে জ্বলছে। সে-সব অস্ত্ৰ যতক্ষণ নিজের মধ্যে রেখেছি ততক্ষণ কথায় কথায় ঘুরে ফিরে নিজেই তার উপরে গিয়ে পড়ছি, ততক্ষণ তারা অহরহ আমাকেই ক্ষতবিক্ষত করছে । এ-সমস্ত তো সঞ্চয় করে রাখবার জন্য নয় । আয়ুধকে ধরতে হবে দক্ষিণহস্তের দৃঢ় মুষ্টিতে ; পথ কেটে বাধা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে বাহির হতে হবে। এসো, এসো, দলে দলে বাহির হয়ে পড়ো-নববর্ষের প্রাতঃকালে পূর্বগগনে আজ জয়ভেরি বেজে উঠছে। সমস্ত অবসাদ কেটে যাক, সমস্ত দ্বিধা সমস্ত আত্ম-অবিশ্বাস পায়ের তলায় ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে যাক।- জয় হােক তোমার, জয় হােক তোমার প্রভুর । না, না, এ শাস্তির নবববর্ষ নয়। সম্বৎসরের ছিন্নভিন্ন বর্ম খুলে ফেলে দিয়ে আজ আবার নূতন বর্ম পরিবার জন্যে এসেছি। আবার ছুটতে হবে। সামনে মহৎ কাজ রয়েছে, মনুষ্যত্ব লাভের দুঃসাধ্য সাধনা । সেই কথা