পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V8V রবীন্দ্র-রচনাবলী এসেছে, ঘরে দারিদ্র্য ; বাইরে বিপদ, অন্তরে বেদনা ; মানুষের চিত্ত সেই ঘন অন্ধকারের মাঝখানে দাড়িয়ে বলেছে : বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ । আমি সেই মহান পুরুষকে জেনেছি যিনি অন্ধকারের পরপর হতে জ্যোতির্ময়রপে প্ৰকাশ পাচ্ছেন । মনুষ্যত্বের তপস্যা সহজ তপস্যা হয় নি, সাধনার দুৰ্গম পথ দিয়ে রক্তমাখা পায়ে মানুষকে চলতে হয়েছে, তবু মানুষ আঘাতকে দুঃখকে আনন্দ বলে গ্ৰহণ করেছে ; মৃত্যুকে অমৃত বলে বরণ করেছে ; ভয়ের মধ্যে অভয়কে ঘোষণা করেছে- এবং “রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং, হে রুদ্র, তোমার যে প্ৰসন্নমুখ সেই মুখ মানুষ দেখতে পেয়েছে। সে দেখা তো সহজ নয় ; সমস্ত অভাবকে পরিপূর্ণ করে দেখা, সমস্ত সীমাকে অতিক্রম করে দেখা । মানুষ সেই দেখা দেখেছে বলেই তো তার সকল কান্নার অশ্রুজিলের উপরে তার গৌরবের পদ্মটি ভেসে উঠেছে ; তার দুঃখের হাটের মাঝখানে তার এই আনন্দসন্মিলন । কিন্তু, বিমুখ চিত্তও আছে, এবং বিরুদ্ধ বাক্যও শোনা যায়। এমন কোন মহৎ সম্পদ মানুষের কাছে এসেছে যার সম্মুখে বাধা তার পরিহাসকুটিল মুখ নিয়ে এসে দাড়ায় নি। তাই এমন কথা শুনি, অনন্তকে নিয়ে তো আমরা উৎসব করতে পারি নে, অনন্ত যে আমাদের কাছে তত্ত্বকথা মাত্র । বিশ্বের মধ্যে তাকে ব্যাপ্ত করে দেখব- কিন্তু, লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের মধ্যে যে বিশ্ব নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, যে বিশ্বের নাড়ীতে নাড়ীতে আলোকধারার আবর্তন হয়ে কত শত শত বৎসর কেটে যায়, সে বিশ্ব আমার কাছে আছে কোথায় । আমাদের উৎসব করা চলে না । এমনি করে তর্কের কথা এসে পড়ে । যখন উপভোগ করি নে, যখন সমস্ত প্ৰাণকে জাগিয়ে দিয়ে উপলব্ধি করি নে, তখনই কলহ করি । ফুলকে যদি প্ৰদীপের আলোয় ফুটতে হত তা হলেই তাকে প্ৰদীপ খুঁজে বেড়াতে হত ; কিন্তু যে সূর্যের আলো আকাশময় ছড়িয়ে যায় ফুল যে সেই আলোয় ফোটে, এইজন্যে তার কাজ কেবল আকাশে আপনাকে মেলে ধরা । আপনি ভিতরকার প্রাণের বিকাশবেগেই সে আপনার পাপড়ির অঞ্জলিটিকে আলোর দিকে পেতে দেয়, তর্ক করে পণ্ডিতের সঙ্গে পরামর্শ করে এ কাজ করতে গেলে দিন বয়ে যেত । হৃদয়কে একান্ত করে অনন্তের দিকে পেতে ধরা মানুষের মধ্যেও দেখেছি, সেইখানেই তো ঐ বাণী উঠেছে : বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ । আমি সেই মহান পুরুষকে দেখেছি। যিনি অন্ধকারের পরপর হতে জ্যোতির্ময়রূপে প্রকাশ পাচ্ছেন। এ তো তর্কযুক্তির কথা হল না ; চোখ। যেমন করে আপনার পাতা মেলে দেখে এ যে তেমনি করে জীবন মেলে দেখা । সত্য হতে অবচ্ছিন্ন করে যেখানে তত্ত্বকথাকে বাক্যের মধ্যে বাধা হয়। সেখানে তা নিয়ে কথা-কাটাকাটি করা সাজে, কিন্তু দ্রষ্টা যেখানে অনন্ত পুরুষকে সমস্ত সত্যেরই মাঝখানে দেখে বলেন “এষঃ, এই-যে তিনি, সেখানে তো কোনো কথা বলা চলে না । “সীমা” শব্দটার সঙ্গে একটা ‘না’ লাগিয়ে দিয়ে আমরা "অসীম' শব্দটাকে রচনা করে সেই শব্দটাকে শূন্যাকার করে বৃথা ভাবতে চেষ্টা করি। কিন্তু অসীম তো 'না' নন, তিনি যে নিবিড় নিরবচ্ছিন্ন ‘ই’ । তাই তো তাকে ওঁ বলে ধান করা হয়। ওঁ যে হী, ওঁ যে যা-কিছু আছে সমস্তকে নিয়ে অখণ্ড পরিপূর্ণতা । আমাদের মধ্যে প্রাণ জিনিসটি যেমন- কথা দিয়ে যদি তাকে ব্যাখ্যা করতে যাই তবে দেখি প্রতি মুহুর্তেই তার ধ্বংস হচ্ছে, সে যেন মৃত্যুর মালা ; কিন্তু তর্ক না করে আপনার ভিতরকার সহজবোধ দিয়ে যদি দেখি তবে দেখতে পাই আমাদের প্রাণ তার প্রতি মুহুর্তের মৃত্যুকে অতিক্রম করে রয়েছে ; মৃত্যুর “না দিয়ে তার পরিচয় হয় না, মৃত্যুর মধ্যে সেই প্ৰাণই হচ্ছে ‘ই’ । সীমার মধ্যে অসীম হচ্ছেন তেমনি ওঁ । তর্ক না করে উপলব্ধি করে দেখলেই দেখা যায় সমস্ত চলে যাচ্ছে, সমস্ত স্বলিত হচ্ছে বটে, কিন্তু একটি অখণ্ডতার বোধ আপনিই থেকে যাচ্ছে। সেই অখণ্ডতার বোধের মধ্যেই আমরা সমস্ত পরিবর্তন সমস্ত গতায়াত সত্ত্বেও বন্ধুকে বন্ধু বলে জানিছি ; নিরস্তর সমস্ত চলে-যাওয়াকে পেরিয়ে থেকে-যাওয়াটাই আমাদের বোধের মধ্যে বিরাজ করছে । বন্ধুকে বাইরের বোধের মধ্যে আমরা খণ্ড খণ্ড করে দেখছি ; কখনো আজ কখনো পাচদিন পরে, কখনো এক ঘটনায় কখনো অন্য ঘটনায় । তার সম্বন্ধে আমার বাইরের বোধটাকে জড়ো করে দেখলে তার পরিমাণ অতি অল্পই হয়, অথচ অন্তরের মধ্যে তার সম্বন্ধে যে-একটি নিরবচ্ছিন্ন বোধের উদয় হয়েছে তার পরিমাণের আর অন্ত নেই, সে