পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শান্তিনিকেতন VeVS भूखिन्ट्स नैका আমাদের আশ্রমের উৎসবের ভিতরকার তত্ত্বটি কী তাই আজ আমাদের বিশেষ করে জানিবার দিন । যে মহাত্মা এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আজ তারই দীক্ষাদিনের সাম্বাৎসরিক । আজকের এই উৎসবটি তার জন্মদিনের বা মৃত্যুদিনের উৎসব নয়, তার দীক্ষাদিনের উৎসব । তার এই দীক্ষার কথাই এই আশ্রমের ভিতরকার কথা । সকলেই জানেন যে, এক সময়ে যখন তিনি যৌবনবয়সে বিলাসের মধ্যে ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত পালিত হয়েছিলেন তখন হঠাৎ তার পিতামহীর মৃত্যু হওয়াতে তার অন্তরে অত্যন্ত বেদনা উপস্থিত হল । সেই বেদনার আঘাতে চারি দিক থেকে আবরণ উন্মোচিত হয়ে গেল । যে সত্যের জন্যে তার হৃদয় লালায়িত হল তাকে তিনি কোথায় পাবেন, তাকে কেমন করে পাবেন, এই ভেবে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন । যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার চারি দিকে যে-সকল অভ্যাস রয়েছে, যে-সব প্রথা চিরকাল চলে আসছে, তারই মধ্যে বেশ আরামে থাকে- যতক্ষণ পর্যন্ত ভিতরে যে সত্য রয়েছে তা তার অন্তরে জাগ্ৰত না হয়ততক্ষণ তার এই বেদনাবোধ থাকে না । যেমন, যখন আমরা ঘুমিয়ে থাকি তখন ছোটাে খাচায় ঘুমোলেও কষ্ট হয় না, কিন্তু জেগে উঠলে আর সেই খাচার মধ্যে থাকতে পারি না । তখন সংকীর্ণ জায়গাতে আর আমাদের কুলোয় না। ধনমান যখন আমাদের বেষ্টন করে থাকে তখন তো আমাদের কোনো অভাব বোধ হয় না। আমরা সংসারে বেশ আরামে আছি। এই মনে করেই নিশ্চিন্ত থাকি। শুধু ধনমান কেন, পুরুষানুক্রমে যে-সব বিধিব্যবস্থা আচার বিচার চলে আসছে তার মধ্যেও নিবিষ্ট থাকলে মনে হয়- এ বেশ, আর নতুন করে কোনো চিন্তা বা চেষ্টা করবার দরকার নেই। কিন্তু, একবার যথার্থ সত্যের পিপাসা জাগ্রত হলে দেখতে পাই যে, সংসারই মানুষের শেষ জায়গা নয়। আমরা যে ধূলোয় জন্মে ধূলোয় মিশব তা নয়। জীবন-মৃত্যুর চেয়ে অনেক বড়ো আমাদের আত্মা । সেই আত্মা উদবোধিত হলে বলে ওঠে : কী হবে আমার এই চিরকালের অভ্যাস নিয়ে, আচার নিয়ে ! এ তো আমার নয় । এতে আরাম আছে, এতে কোনো ভাবনা চিন্তা নেই, এতেই সংসার চলে যাচ্ছে, তা জানি । কিন্তু, এ আমার নয় - সংসারের পনেরো-আনা লোক যেমন ধনমানে বেষ্টিত হয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আছে তেমনি যে-সমস্ত আচারবিচার চলে আসছে তারও মধ্যে তারা আরামে রয়েছে। কিন্তু, একবার যদি কোনো আঘাতে এই আবরণ ছিন্ন হয়ে যায় অমনি মনে হয় ; এ কী কারাগার ! এ আবরণ তো আশ্রয় নয় । এক-একজন লোক সংসারে আসেন যাদের কোনো আবরণে আবদ্ধ করতে পারে না । তাদের জীবনেই বড়ো বড়ো আঘাত এসে পৌছয় আবরণ ভাঙবার জন্যে, এবং তারা সংসারে যাকে অভ্যস্ত আরাম বলে লোকে অবলম্বন করে নিশ্চিন্ত থাকে তাকে কারাগার বলেই নির্দেশ করেন । আজ র্যার কথা বলছি তার জীবনে সেই ঘটনা ঘটেছিল । তার পরিবারো ধনমানের অভাব ছিল না, চিরাগত প্ৰথা সেখানে আচরিত হত । কিন্তু, এক মুহুর্তেই মৃত্যুর আঘাতে তিনি যেমনি জাগলেন অমনি বুঝলেন যে এর মধ্যে শান্তি নেই। তিনি বললেন ; আমার পিতাকে আমি জানতে চাই- দশজনের মতো করে তাকে জানতে চাই না, তাকে জানতে পারি না । সত্যকে তিনি জীবনে প্রত্যক্ষভাবে জানতে চেয়েছিলেন ; দশজনের মুখের কথায় শান্ত্রবাক্যে আচারে।-বিচারে তঁকে জানিবার চেষ্টাকে তিনি পরিহার করেছিলেন । সেই যে তার উদবোধন, সে প্ৰত্যক্ষ সত্যের মধ্যে উদবোধন ; সেই প্ৰথমযৌবনের প্রারম্ভে যে তার দীক্ষা-গ্ৰহণ সে মুক্তির দীক্ষা-গ্ৰহণ । যেদিন পক্ষীশাবকের পাখা ওঠে সেইদিনই পক্ষীমাতা তাকে উড়তে শেখায় । তেমনি তারই দীক্ষার দরকার যার মুক্তির দরকার। চারি দিকের জড় সংস্কারের আবরণ থেকে তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন । তার কাছে সেই মুক্তির দীক্ষা নেব বলেই আমরা আশ্রমে এসেছি। ঈশ্বরের সঙ্গে যে আমাদের স্বাধীন মুক্ত যোগ সেইটে আমরা এখানে উপলব্ধি করব ; যে-সব কাল্পনিক কৃত্রিম ব্যবধােন তঁর সঙ্গে আমাদের যোগ হতে দিচ্ছে না। তার থেকে আমরা মুক্তি লাভ করব । যেটা কারাগার তার পিঞ্জরের প্রত্যেক শলাকাটি যদি সোনার শলাকা হয় তবু সে কারাগার, তার মধ্যে মুক্তি নেই। এখানে আমাদের সকল কৃত্রিম বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে হবে। এখানে মুক্তির সেই দীক্ষা নেবার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। সেই দীক্ষাটিই