পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (অষ্টাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S N.N. রবীন্দ্র-রচনাবলী বলে আত্মসম্মান। নিরস্তর দারিদ্র্যের ভিতর দিয়েই শান্তিনিকেতন আপনি আন্তরিক চরিতার্থতা প্রকাশের সাধনায় নিযুক্ত ছিল এতেই বোধ করি বেশি করে তঁর হৃদয় আকর্ষণ করেছিল। আমার সঙ্গে অ্যােন্ডরুজের যে প্রতির সম্বন্ধ ছিল সেই কথাটাই এতক্ষণ বললুম। কিন্তু সকলের চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল ভারতবর্ষের প্রতি তার একনিষ্ঠ প্রেম। তার এই নিষ্ঠা দেশের লোক অকুষ্ঠিতমনে গ্রহণ করেছে কিন্তু তার সম্পূর্ণ মূল্য কি স্বীকার করতে পেরেছিল? ইনি ইংরেজ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। কী ভাষায় কী আচারে কী সংস্কৃতিতে সকল দিকেই এর আজন্মকালের নাড়ীর যোগ ইংলন্ডের সঙ্গে। র্তার আত্মীয়মণ্ডলীর কেন্দ্র ছিল সেইখানেই। যে ভারতবর্ষকে তিনি একান্ত আত্মীয় বলে চিরদিনের মতো স্বীকার করে নিলেন, তঁর দেহমানের সমস্ত অভ্যাসের থেকে তার সমাজব্যবহারের ক্ষেত্র ছিল বহুদূরে। এই একান্ত নির্বাসনের পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি প্রকাশ করেছেন তীর বিশুদ্ধ প্রেমের মাহাত্ম্য। এ দেশে এসে নির্লিপ্ত সাবধানিতার সঙ্গে দূরের থেকে ভারতবর্ষকে তীর প্রসাদ বিতরণ করেন নি, অসংকোচে তিনি এখানকার সর্বসাধারণের সঙ্গে সবিনয় যোগ রক্ষা করেছেন। যারা দীন, যারা অবজ্ঞাভাজন, যাদের জীবনযাত্রা তাদের আদর্শে মলিন শ্ৰীহীন নানা উপলক্ষে সহজ আত্মীয়তায় তাদের সহবাস অনায়াসেই তিনি গ্ৰহণ করেছেন। এ দেশের শাসক-সম্প্রদায় যারা তার এই আচরণ প্রত্যক্ষ করেছেন তারা আপনাদের রাজপ্রতিপত্তির অসম্মান অনুভব করে তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন তাকে ঘূণা করেছেন তা আমরা জানি, তবু স্বজাতির এই অশ্রদ্ধার প্রতি তিনি ভ্ৰক্ষেপমাত্র করেন নি। র্তার যিনি আরাধ্য দেবতা ছিলেন তাকে তিনি জনসমাজের অভাজনদের বন্ধু বলে জানতেন তারই কাছ থেকে শ্রদ্ধা। তিনি অস্তরের সঙ্গে প্রার্থনা করেছেন। এই ভারতবর্ষে কী পরের কী আমাদের নিজের কাছে যেখানেই মানুষের প্রতি অবজ্ঞা অবারিত সেখানেই সকল বাধা অতিক্রম করে তিনি আপন খৃস্টভক্তিকে জয়যুক্ত করেছেন। এই প্রসঙ্গে এ কথা বলতে হবে অনেক বার আমাদের দেশের লোকের কাছ থেকেও তিনি বিরুদ্ধতা ও সন্দিগ্ধ ব্যবহার পেয়েছিলেন, সেই অন্যায় আঘাত অস্নানচিত্তে গ্রহণ করাও যে ছিল তীর পূজারই অঙ্গ। যে-সময়ে অ্যােন্ডরুজ ভারতবর্ষকে আপনি আমৃত্যুকালের কর্মক্ষেত্ররূপে স্বীকার করে নিয়েছিলেন সেই সময়ে এ দেশে রাষ্ট্ৰীয় উত্তেজনা ও সংঘাত প্রবলভাবে জেগে উঠেছিল। এমন অবস্থায় এ দেশীয়দের মধ্যে আপন সৌহৃদ্যের আসন রক্ষা করে তিষ্ঠে থাকা ইংরেজের পক্ষে কত দুঃসাধ্য সে কথা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু দেখেছি তিনি ছিলেন অতি সহজে তার আপন স্থানে, তার মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। এই যে অবিচলিতচিত্তে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে জীবনের লক্ষ্য স্থির রাখা, এতেই তার আত্মিক শক্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। যে অ্যােন্ডরুজকে আমি জানি দুই দিক থেকে তীর পরিচয় পাবার সুযোগ আমার হয়েছে, এক আমার অত্যন্ত কাছে, আমার প্রতি সুগভীর ভালোবাসায়। এমনতরো অকৃত্রিম অপর্যাপ্ত ভালোবাসাকে আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৌভাগ্যের মধ্যে গণ্য করি। আর দেখেছি দিনে দিনে নানা উপলক্ষে ভারতবর্ষের কাছে তার অসামান্য আত্মোৎসর্গ। দেখেছি তার অশেষ করুণা এ দেশের অস্ত্যজদের প্রতি। তাদের কোনাে দুঃখ বা অসম্মান যখনি তীকে আহবান করেছে তখনি নিজের অসুবিধা বা অস্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য না রেখে সকল কাজ ফেলে ছুটে গিয়েছেন তাদের মদ্যে। এইজন্যেই তাকে স্থিরভাবে আমাদের কোনো নির্দিষ্ট কাজে বেঁধে রাখা उजळुत्र छ्ळि । এই যে র্তার প্রতি এ যে সংকীর্ণভাবে ভারতবর্ষের সীমাগত সে কথা বললে ভুল বলা হবে। তীর খৃস্টধর্মে সর্বমানবের প্রতি প্রীতির যে অনুশাসন আছে ভারতীয়দের প্রতি প্রতি তারই এক অংশ। একদা তারই প্রমাণ পেয়েছিলুম যখন দক্ষিণ-আফ্রিকার কফ্রি অধিবাসীদের সম্বন্ধে তীর উৎকণ্ঠা দেখেছি, যখন সেখানকার ভারতীয়েরা কাফ্রিদেরকে আপনাদের থেকে স্বতন্ত্র করে হেয় করে দেখবার চেষ্টা করেছিল, এবং যুরোপীয়দের মতোই তাদের চেয়ে আপনাদের উচ্চাধিকার