পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& о о রবীন্দ্র-রচনাবলী বচিভঙ্গবিহীন প্রশাস্ত যমুনাবক্ষোবাহিত একখানি অদৃশু জীণ নৌকা সেই জ্যোৎস্না রজনীর সৌম্যম্বন্দর শাস্তশীতল অনন্ত ভুবনমোহন মৃত্যুর প্রসারিত আলিঙ্গনপাশ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া আমাকে জীবনের পথে টানিয়া লইয়া চলিল। আমি মোহস্বপ্নাভিহতার স্তায় যমুনার তীরে তীরে কোথাও-বা কাশবন, কোথাও-বা মরুবালুক কোথাও-বা বন্ধুর বিদীর্ণ তট, কোথাও-বা ঘনগুল্মছৰ্গম বনখণ্ডের ভিতর দিয়া চলিতে লাগিলাম।” এইখানে বক্তা চুপ করিল। আমিও কোনো কথা কছিলাম না । অনেকক্ষণ পরে নবাবদুহিত কহিল, "ইহার পরে ঘটনাবলী বড়ো জটিল । সে কেমন করিয়া বিশ্লেষ করিয়া পরিষ্কার করিয়া বলিব জানি না । একটা গহন অরণ্যের মাঝখান দিয়া যাত্রা করিয়াছিলাম, ঠিক কোন পথ দিয়া কখন চলিয়াছিলাম সে কি আর খুজিয়া বাহির করিতে পারি। কোথায় আরম্ভ করিব, কোথায় শেষ করিব, কোনটা ত্যাগ করিব, কোনটা রাখিব, সমস্ত কাহিনীকে কী উপায়ে এমন স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করিয়া তুলিব যাহাতে কিছুই অসাধ্য অসম্ভব অপ্রকৃত বোধ না হয়। 尊 কিন্তু জীবনের এই কয়টা দিনে ইহা বুঝিয়াছি যে, অসাধ্য অসম্ভব কিছুই নাই। নবাব-অন্তঃপুরের বালিকার পক্ষে বাহিরের সংসার একান্ত দুর্গম বলিয়া মনে হইতে পারে, কিন্তু তাহা কাল্পনিক ; একবার বাহির হইয়া পড়িলে একটা চলিবার পথ থাকেই । সে-পথ নবাবি পথ নহে, কিন্তু পথ ; সে-পথে মানুষ চিরকাল চলিয়া আসিয়াছে— তাহা বন্ধুর বিচিত্র সীমাহীন, তাহা শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত, তাহা স্বখেদুঃখে বাধাবিল্পে জটিল, কিন্তু তাহা পথ । এই সাধারণ মানবের পথে একাকিনী নবাবদুহিতার সুদীর্ঘ ভ্রমণবৃত্তান্ত মুখশ্রাব্য হইবে না, হইলেও সে-সব কথা বলিবার উৎসাহ আমার নাই। এক কথায়, দুঃখকষ্ট বিপদ অবমাননা অনেক ভোগ করিতে হইয়াছে, তবু জীবন অসহ্য হয় নাই । আতশবাজির মতো যত দাহন ততই উদাম গতি লাভ করিয়াছি। যতক্ষণ বেগে চলিয়াছিলাম ততক্ষণ পুড়িতেছি বলিয়া বোধ ছিল না, আজ হঠাৎ সেই পরম দুঃখের সেই চরম স্থখের আলোকশিখাটি নিবিয়া গিয়া এই পথপ্রান্তের ধূলির উপর জড়পদার্থের স্তায় পড়িয়া গিয়াছি— আজ আমার যাত্রা শেষ হইয়া গেছে, এইখানেই আমার কাহিনী সমাপ্ত ।” এই বলিয়া নবাবপুত্রী থামিল। আমি মনে মনে ঘাড় নাড়িলাম ; এখানে তো