পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○○ 。 রবীন্দ্র-রচনাবলী যে তিনি এই সকল ইত্যাদি ইত্যাদি । I হা পরলোকগত পিতঃ পূর্ণেন্দুশেখর ! ইংরাজের নিকট এত নাম এত বিশ্বাস সঞ্চয় করিয়া। তবে তুমি মরিয়াছিলে ! এ চিঠিখানিও শ্যালীর নিকট পেখমের মতো বিস্তার করিয়া ধরিবার যোগ্য । ইহার মধ্যে একটা কথা আছে যে, নবেন্দু আখ্যাত অকিঞ্চন লক্ষ্মীছাড়া নহেন, তিনি সারবান পদার্থবান লোক । লাবণ্য পুনশ্চ আকাশ হইতে পড়িয়া কহিল, “এ আবার তোমার, কোন পরমবন্ধু লিখিল ! কোন নীলরতন কহিল, “এ চিঠির একটা প্ৰতিবাদ করা তো তোমার উচিত ।” নবেন্দু কিছু উচু চালে বলিল, “দরকার কী ! যে যা বলে তাঁহারই কি প্রতিবাদ করিতে হইবে।” লাবণ্য উচ্চৈঃস্বরে চারি দিকে একেবারে হাসির ফোয়ারা ছড়াইয়া দিল । নবেন্দু অপ্রতিভ হইয়া কহিল, “এত হাসি যে !” তাহার উত্তরে লাবণ্য পুনর্বার অনিবার্য বেগে হাসিয়া পুম্পিতিযৌবনা দেহলতা লুষ্ঠিত করিতে व्लानि । নবেন্দু নাকে মুখে চোখে এই প্রচুর পরিহাসের পিচকারি খাইয়া অত্যন্ত নাকাল হইল। একটু ক্ষুন্ন হইয়া কহিল, “তুমি মনে করিতেছ, প্রতিবাদ করিতে আমি ভয় করি ” লাবণ্য কহিল, “তা কেন । আমি ভাবিতেছিলাম, তোমার অনেক আশাভরসার সেই ঘোড়দৌড়ের মাঠখানি বাচাইবার চেষ্টা এখনো ছাড়া নাই— যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ ।” নবেন্দু কহিল, “আমি বুঝি সেইজন্য লিখিতে চাহি না ?” অত্যন্ত রাগিয়া দোয়াতকলম লইয়া বসিল । কিন্তু, লেখার মধ্যে রাগের রক্তিমা বড়ো প্ৰকাশ পাইল না, কাজেই লাবণ্য ও নীলরতনকে সংশোধনের ভার লইতে হইল । যেন লুচিভাজার পালা পড়িল ; নবেন্দু যেটা জলে ও ঘিয়ে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা নরম নরম করিয়া এবং চাপিয়া যথাসাধ্য চেপটা করিয়া বেলিয়া দেয় তাহার দুই সহকারী তৎক্ষণাৎ সেটাকে ভাজিয়া কড়া ও গরম করিয়া ফুলাইয়া ফুলাইয়া তোলে । লেখা হইল যে, আত্মীয় যখন শক্রি হয় তখন বহিঃশত্রু অপেক্ষা ভয়ংকর হইয়া উঠে । পাঠান অথবা রাশিয়ান সহিত প্ৰজাসাধারণের নিরাপদ সৌহার্দাবন্ধনের তাহারাই দুৰ্ভেদ্য অন্তরায় । কনগ্রেস রাজা ও প্রজার মাঝখানে স্থায়ী সদ্ভাবসাধনের যে প্রশস্ত রাজপথ খুলিয়াছে, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কাগজগুলো ঠিক তাহার মধ্যস্থল জুডিয়া একেবারে কন্টকিত হইয়া রহিয়াছে। ইত্যাদি । নবেন্দুর ভিতরে ভিতরে ভয়-ভয় করিতে লাগিল অথচ "লেখাটা বড়ো সরেস হইয়াছে' মনে করিয়া, রহিয়া রহিয়া একটু আনন্দও হইতে লাগিল। এমন সুন্দর রচনা তাহার সাধ্যাতীত ছিল । ইহার পর কিছুদিন ধরিয়া নানা কাগজে বিবাদবিসম্বাদ-বাদপ্রতিবাদে নবেন্দুর চাঁদা এবং কনগ্রেসে যোগ দেওয়ার কথা লইয়া দশ দিকে ঢাক বাজিতে লাগিল । নবেন্দু এক্ষণে মরিয়া হইয়া কথায় বার্তায় শ্যালীসমাজে অত্যন্ত নিভীক দেশহিতৈষী হইয়া উঠিল । লাবণ্য মনে মনে হাসিয়া কহিল, “এখনো তোমার অগ্নিপরীক্ষা বাকি আছে ।” একদিন প্ৰাতঃকালে নবেন্দু স্নানের পূর্বে বক্ষস্থল তৈলাক্ত করিয়া পৃষ্ঠদেশের দুৰ্গম অংশগুলিতে তৈলসঞ্চার করিবার কৌশল অবলম্বন করিতেছেন, এমন সময় বেহার এক কার্ড হাতে করিয়া তাহাকে দিল, তাহাতে স্বয়ং ম্যাজিষ্ট্রেটের নাম আঁকা। লাবণ্য সহাস্যকুতুহলী চক্ষে আড়াল হইতে কৌতুক দেখিতেছিল । তৈললাঞ্ছিত কলেবরে তো ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত সাক্ষাৎ করা যায় না— নবেন্দু ভাজিবার পূর্বে মসলা-মাখা কই-মৎস্যের মতো বৃথা ব্যতিব্যস্ত হইতে লাগিলেন । তাড়াতাড়ি চকিতের মধ্যে স্নান করিয়া কোনোমতে কাপড় পরিয়া উধৰ্বশ্বাসে বাহিরের ঘরে গিয়া উপস্থিত হইলেন । বেহােরা বলিল, “সাহেব অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া চলিয়া গিয়াছেন।” এই আগাগোড়া মিথ্যাচরণ পাপের কতটা অংশ