পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8ՊO রবীন্দ্র-রচনাবলী গহনা বেচিয়া বা বন্ধক দিয়া টাকা লইতে পরিবেন। এ আমার মায়ের জিনিস- এ আমারই জিনিস।” এ ছাড়া আরো অনেক কথা- সে কোনো কাজের কথা নহে। হরলাল ঘরে তালা দিয়া তাড়াতাড়ি একখানা গাড়ি লইয়া গঙ্গার ঘাটে দুটিল । কোন জাহাজে বেণু যাত্রা করিয়াছে তাহার নামও সে জানে না। মেটিয়াবুরুজ পর্যন্ত চুটিয়া হরলাল খবর পাইল দুইখানা জাহাজ ভোরে রওনা হইয়া গেছে। দুখানাই ইংলন্ডে যাইবে । কোন জাহাজে বেণু আছে তাহও তাহার অনুমানের অতীত এবং সে জাহাজ ধরিবার যে কী উপায় তাহাও সে ভাবিয়া পাইল না । মেটিয়াবুরুজ হইতে তাহার বাসার দিকে যখন গাড়ি ফিরিল তখন সকালের রৌদ্রে কলিকাতা শহর জাগিয়া উঠিয়াছে। হরলালের চোখে কিছুই পড়িল না । তাহার সমন্ত হতবুদ্ধি অন্তঃকরণ একটা কলেবরহীন নিদারুণ প্রতিকূলতাকে যেন কেবলই প্ৰাণপণে ঠেলা মারিতেছিল- কিন্তু কোথাও এক তিলও তাহাকে টলাইতে পারিতেছিল না । যে বাসায় তাহার মা থাকেন, এতদিন যে বাসায় পা দিবামাত্র কর্মক্ষেত্রের সমন্ত ক্লান্তি ও সংঘাতের বেদনা মুহুর্তের মধ্যেই তাহার দূর হইয়া গিয়াছে, সেই বাসার সম্মুখে গাড়ি আসিয়া দাড়াইল- গাড়োয়ানের ভাড়া চুকাইয়া দিয়া সেই বাসার মধ্যে সে অপরিমেয় নৈরাশ্য ও ভয় লইয়া প্রবেশ করিল। মা উদবিগ্ন হইয়া বারান্দায় দাড়াইয়া ছিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, কোথায় গিয়াছিলো।” হরলাল বলিয়া উঠিল, “মা, তোমার জন্য বউ আনিতে গিয়াছিলাম।” বলিয়া শুককণ্ঠে হাসিতে হাসিতে সেইখানেই মূছিত হইয়া পড়িয়া গেল। “ও মা, কী হইল গো” বলিয়া মা তাড়াতাড়ি জল আনিয়া তাহার মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগিলেন । কিছুক্ষণ পরে হরলাল চোখ খুলিয়া শূন্যদৃষ্টিতে চারিদিকে চাহিয়া উঠিয়া বসিল । হরলাল কহিল, “মা, তোমরা ব্যস্ত হইয়ো না। আমাকে একটু একলা থাকিতে দাও।” বলিয়া সে তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিয়া দিল । মা দরজার বাহিরে মাটির উপর বসিয়া পড়িলেন- ফায়ুনের রৌদ্র তাহার সর্বাঙ্গে আসিয়া পড়িল । তিনি রুদ্ধ দরজার উপর মাথা রাখিয়া থাকিয়া থাকিয়া কেবল ডাকিতে লাগিলেন, “হরলাল, বাবা হরলাল ।” হরলাল কহিল, “মা, একটু পরেই আমি বাহির হইব, এখন তুমি যাও।” মা রৌদ্রে সেইখানেই বসিয়া জপ করিতে লাগিলেন । আপিসের দরোয়ান আসিয়া দরজায় ঘা দিয়া কহিল, “বাবু, এখনই না বাহির হইলে আর গাড়ি পাওয়া যাইবে না ।” হরলাল ভিতর হইতে কহিল, “আজি সাতটার গাড়িতে যাওয়া হইবে না ।” দরোয়ান কহিল, “তবে কখন যাইবেন ।” হরলাল কহিল, “সে আমি তোমাকে পরে বলিব ।” দরোয়ান মাথা নাড়িয়া হাত উলটাইয়া নীচে চলিয়া গেল । হরলাল ভাবিতে লাগিল, “এ কথা বলি কাহাকে । এ যে চুরি । বেণুকে কি জেলে দিব।' হঠাৎ সেই গহনার কথা মনে পড়িল । সে কথাটা একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছিল। মনে হইল যেন কিনারা পাওয়া গেল। ব্যাগ খুলিয়া দেখে তাহার মধ্যে শুধু আংটি ঘড়ি বোতাম হার নহে- ব্রেসলেট চিক সিঁথি মুক্তার মালা প্রভৃতি আরো অনেক দামি গহনা আছে । তাহার-দাম তিন হাজার টাকার অনেক বেশি। কিন্তু এও তো চুরি । এও তো বেণুর নয় । এ ব্যাগ যতক্ষণ তাহার ঘরে থাকে ততক্ষণ তাহার বিপদ । তখন আর দেরি না করিয়া অধরলালের সেই চিঠি ও ব্যাগ লইয়া হরলাল ঘর হইতে বাহির হইল । মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাও, বাবা ।” হরলাল কহিল, “অধরবাবুর বাড়িতে।” মারি বুক হইতে হঠাৎ অনির্দিষ্ট ভয়ের একটা মন্ত বোঝা নামিয়া গেল । তিনি স্থির করিলেন, ঐ-যে