পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8& e রবীন্দ্র-রচনাবলী করিয়া তুলিতে না পারিলে তাহার স্থখ হয় না। আমরা দেখিয়াছি, ব্রিটিশ ভোজে খরগোশ রাধিয়া জন্তুটাকে যথাসম্ভব অবিকল রাখিয়াছে। সেটা ষে স্থখাদ্য ইহাই যথেষ্ট আমোদের নহে ; কিন্তু সেটা ষে একটা বাস্তব জন্তু, ব্রিটিশ ভোগী তাহ প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে চায়। ব্রিটিশ খান যে কেবল খান তাহা নহে, তাহ প্রাণিবৃত্তান্তের গ্রন্থবিশেষ বলিলেই হয়। যদি কোনো ব্যঞ্জনে পাখিগুল ভাজা ময়দার আবরণে ঢাকা পড়ে, তবে তাহদের পাগুলা কাটিয়া আবরণের উপরে বসাইয়া রাখা হয়। বাস্তব এত আবশ্বক। কল্পনার নিজ এলাকার মধ্যেও ব্রিটিশ পাঠক বাস্তবের সন্ধান করে— তাই কল্পনাকেও দায়ে পড়িয়া প্রাণপণে বাস্তবের ভান করিতে হয়। যে ব্যক্তি অসম্ভব স্থান হইতেও সাপ দেখিতেই চায়, সাপুড়ে তাহাকে ঠকাইতে বাধ্য হয়। সে নিজের ঝুলির ভিতর হইতেই সাপ বাহির করে, কিন্তু ভান করে যেন দর্শকের চাদরের মধ্য হইতে বাহির হইল। কিপলিঙ নিজের কল্পনার ঝুলি হইতেই সাপ বাহির করিলেন, কিন্তু নৈপুণ্যগুণে ব্রিটিশ পাঠক ঠিক বুঝিল যে, এশিয়ার উত্তরায়ের ভিতর হইতেই সরীস্থপগুল দলে দলে বাহির হইয়া আসিল । বাহিরের বাস্তব সত্যের প্রতি আমাদের এরূপ একান্ত লোলুপতা নাই। আমরা কল্পনাকে কল্পনা জানিয়াও তাহার মধ্য হইতে রস পাই। এজস্ত গল্প শুনিতে বলিয়া আমরা নিজেকে নিজে ভুলাইতে পারি ; লেখককে কোনোরূপ ছলনা অবলম্বন করিতে হয় না। কাল্পনিক সত্যকে বাস্তব সত্যের ছদ্ম-গোফ-দাড়ি পরিতে হয় না। আমরা বরঞ্চ বিপরীত দিকে যাই । আমরা বাস্তব সত্যে কল্পনার রঙ ফলাইয়া তাহাকে অপ্রাকৃত করিয়া ফেলিতে পারি, তাহাতে আমাদের দুঃখবোধ হয় না। আমরা বাস্তব সত্যকেও কল্পনার সহিত মিশাইয় দিই, আর যুরোপ কল্পনাকেও বাস্তব সত্যের মূর্তি পরিগ্রহ করাইয়া তবে ছাড়ে। আমাদের এই স্বভাবদোষে আমাদের বিস্তর ক্ষতি হইয়াছে, আর ইংরেজের স্বভাবে ইংরেজের কি কোনো লোকসান করে নাই ? গোপন মিথ্যা কি সেখানে ঘরে-বাহিরে বিহার করিতেছে না ? সেখানে খবরের কাগজে খবর বানানো চলে তাহা দেখা গিয়াছে এবং সেখানে ব্যাবসাদার-মহলে শেয়ার-কেনাবেচার বাজারে যে কিরূপ সর্বনেশে মিথ্যা বানানো হইয়া থাকে তাহ কাহারও অগোচর নাই। বিলাতে বিজ্ঞাপনের অত্যুক্তি ও মিথ্যোক্তি নানা বর্ণে নানা চিত্রে নানা অক্ষরে দেশে বিদেশে নিজেকে কিরূপ ঘোষণা করে তাহা আমরা জানি— এবং আজকাল আমরাও ভদ্রাভত্রে মিলিয়া নির্লজভাবে এই অভ্যাস গ্রহণ করিয়াছি। বিলাতে পলিটিকৃসে বানানো বাজেট তৈরি করা, প্রশ্নের বানানো উত্তর দেওয়া প্রভৃতি অভিযোগ তুলিয়া এক পক্ষের প্রতি অপর পক্ষে যে-সকল দোষারোপ করিয়া থাকেন