8१२ রবীন্দ্র-রচনাবলী আমার লোপ। কিন্তু নিজেকে সকলের সহিত মিলিত করিয়া উপলব্ধি করিলেই মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুভয় দূর হইয়া যায়, কারণ তখন আমি জানি সকলের সঙ্গে আমি এক, সকলের জীবনের মধ্যেই আমি জীবিত। এই সত্য উপলব্ধি করিয়াই জাপানের শত সহস্ৰ বীর দেশের জন্য অনায়াসে আপনার প্রাণ উৎসর্গ করিয়াছে। আমরা যে নিজের প্রাণটাকে টাকার থলিটাকে একান্ত আগ্রহে জাকড়িয়া বসিয়া থাকি, নিজেকে এক বলিয়া জানাই ইহার একমাত্র কারণ। যদি আজ আমি সমস্ত দেশকেই 'আমি বলিয়া জানিতে পারি তবে আমার ভয়কে, আমার লোভকে, দেশের মধ্যে মুক্তিদান করিয়া দেবত্ব লাভ করিতে পারি, অসাধ্য সাধন করিতে পারি। তখন যে নিতান্ত ক্ষুদ্র সেও বৃহৎ হয়, ষে নিতাস্ত দুর্বল সেও সবল হইয়া উঠে । আজ কতকাল পরে আমরা বাংলাদেশে এই সত্যের আভাস পাইয়াছি। সেইজন্ত যাহার কাছে যাহা প্রত্যাশা করি নাই তাহাও লাভ করিলাম। সেইজন্ত আমরা আপনাতে আপনি বিস্মিত হইয়াছি। সেইজন্য আজ আমাদের বাঙালির চিত্তসম্মিলনের ক্ষেত্র হইতে যাহারা পৃথক হইয়া আছেন তাহাদের ব্যবহার আমাদিগকে এমন কঠোর আঘাত করিতেছে— যাহারা ভয় পাইতেছেন, দ্বিধা করিতেছেন, সকল দিক বাচাইবার জন্য নিস্ফল চেষ্টা করিতেছেন, তাহীদের প্রতি আমাদের অন্তরের অবজ্ঞা এমন দুনিবার বেগে উদ্বেল হইয়া উঠিতেছে। আমাদের মধ্যে যাহারা বিলাসে অভ্যন্ত ছিলেন তাহারা বিলাস-উপকরণের জন্য লজ্জিত হইতেছেন, র্যাহাদিগকে চপলচিত্ত বলিয়া জানিতাম তাহারা কঠিন ব্রত গ্রহণ করিতে কুষ্ঠিত হইতেছেন না, যাহারা বিদেশী আড়ম্বরের অগ্নিশিখায় পতঙ্গের মতো বাপ দিয়াছিলেন তাহাদিগকে সেই সাংঘাতিক প্রলয়দীপ্তি আর প্রলুদ্ধ করিতেছে না। ইহার কারণ কী ? ইহার কারণ, আমরা সত্য বস্তুর আভাস পাইয়াছি, সেই সত্যের আবির্ভাবমাত্রেই আমরা বৃহৎ হইয়াছি, বলিষ্ঠ হইয়াছি। এখন ঈশ্বরের কাছে একান্তমনে প্রার্থনা করি, এই সত্য যেন ক্রমশ উজ্জলতর হইয়া উঠে, এই সত্যকে যেন আবার একদিন আমাদের শিখিল মুষ্টি হইতে জ্বলিত হইতে না দিই, অন্তকার সংঘাতজনিত উত্তেজনা যখন একদিন শাস্ত হইয়া আসিবে তখন যেন জীবনের প্রতিদিন এই সত্যকে আমরা অপ্রমত্তচিত্তে সকল কর্মে ধারণ ও পোষণ করিতে পারি। মনে রাখিতে হইবে, আজ স্বদেশের স্বদেশীয়তা আমাদের কাছে যে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে ইহা রাজার কোনো প্রসাদ বা অপ্রসারে নির্ভর করে না ; কোনো জাইন পাস হউক বা না হউক, বিলাতের লোক আমাদের করণোক্তিতে কর্ণপাত করুক বা না করুক, আমার স্বদেশ আমার চিরন্তন স্বদেশ,
