পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ব্যঙ্গকৌতুক । শুধু ধূলি, শুধু ছাই, মূল্য যার কিছু নাই ○ V মূল্য তারে করো সমর্পণ তব স্পর্শে পরাশরাতন ! তোমার গৌরবে যবে আমার গৌরব হবে একেবারে দিব বিসর্জন । চরণে হৃদয় প্ৰাণ মন । আশু । (স্বগত) আর মন্ত্রের দরকার নেই | বশীকরণের আর কী বাকি রইল । কন্যাটি দেবকন্যা । (প্রকাশ্যে) মাতাজি ! / শ্যামা | কী বাবা ? আশু । আমাকে আপনার পুত্র করেই রাখবেন, এমন সুধাসংগীত শোনবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন না। যা পাওয়া গেল এই আমি পরম লাভ মনে করছি। মন্ত্রতন্ত্রের কথা ভুলেই গেছি। এখন । শ্যামা । অমন কথা বোলো না বাবা ! মস্ত্রের দরকার আছে বৈকি । নইলে শাস্ত্ৰেআশু । সে তো ঠিক কথা । মন্ত্র আমি অগ্রাহ্য করি নে। আমি বলছিলেম মন্ত্র পড়লেই যে মন বশ হয় তা নয়, গানের মােহিনী শক্তির কাছে কিছুই লাগে না। (স্বগত) মেয়েটি আবার লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। ভারি লাজুক ! শ্যামা । (আত্মগত) ছেলেটি খুব ভালো । কিন্তু একটু যেন লজ্জা কম বলে বোধ হয় । মন বশ করার কথাগুলো শাশুড়ির সামনে না বললেই ভালো হত। । আশু । কিন্তু আপনি বিরক্ত হবেন না, আমার যা মনে উদয় হচ্ছে। আমি বলি, তার পরেশ্যামা। তা বাবা, সে-সব কথা এখন থােক। আগেআশু । আমি বলছিলেম, গানে যে মন বশ হয় সেও তো শব্দমাত্র ; মনের সঙ্গে তার যদি যোগ থাকে তা হলে মস্ত্রের শব্দশক্তিকেই বা না মানি কী বলে ? শ্যামা । ঠিক কথা । মন্ত্রটা মানাই ভালো । আশু । (সোৎসাহে) আপনার কাছে এ-সব কথা বলা আমার পক্ষে ধূষ্টতা, কিন্তু শব্দী শক্তির সঙ্গে আত্মার যে একটি নিগুঢ় যোগ আছে তার স্বরূপ নিরূপণ করা কঠিন, তর্কলংকারমশায় বলেন সে অনির্বাচনীয় । শাস্ত্ৰে যে বলে শব্দ ব্ৰহ্ম, তার কারণ কী ? ব্ৰহ্মই যে শব্দ বা শব্দই যে ব্ৰহ্ম তা নয় ; কিন্তু ব্ৰহ্মের ব্যবহারিক সত্তার মধ্যে শব্দস্বরূপেই ব্রহ্মের প্রকাশ যেন নিকটতম। (নিরুপমার প্রতি) আপনি তো। এ-সকল বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছেন, আপনার কি মনে হয় না রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের চেয়ে শব্দই যেন আমাদের আত্মার অব্যবহিত প্রত্যক্ষের বিষয় ? সেইজন্যই এক আত্মার সঙ্গে আর-এক আত্মার মিলনসাধনের প্রধান উপায় শব্দ। আপনি কী বলেন ? (স্বগত) মেয়েটি ভারি লাজুক ! শ্যামা। বলো-না মা, যা জিজ্ঞাসা করছেন বলে। এত বিদ্যে শিখলে, এই কথাটার উত্তর দিতে পািরছ না ?- বাবা, প্রথম দিন। কিনা, তাই লজ্জা করছে। ও যে কিছু শেখে নি তা মনে কোরো না । আশু । ওঁর বিদ্যার উজ্জ্বলতা মুখশ্ৰীতেই প্রকাশ পাচ্ছে। আমি কিছুমাত্র সন্দেহ করছি নে। শ্যামা। নিরু, মা, একবার ও ঘরে যাও তাে। [নিরুপমার প্রস্থান দেখো বাবা, মেয়েটির বাপ নেই, সকল কথা আমাকেই কইতে হচ্ছে, তুমি কিছু মনে কোরো না ! আশু । মনে করব! বলেন কী ! আপনার কথা শুনতেই তাে এসেছিলেম— বাচালের মতাে কেবল নিজেই কতকগুলো বকে গেলেম । আমাকে মাপ করবেন। শ্যামা । তোমার যদি মত থাকে তা হলে একটা দিনস্থির করতে হচ্ছে তো ? আশু । (স্বগত) আমি ভেবেছিলেম, আজই সমস্ত হয়ে যাবে। কিন্তু আজ বৃহস্পতিবার, তাই বো হয় হল না । (প্রকাশ্যে) তা, আসছে। রবিবারেই যদি স্থির করেন ? শ্যামা। বল কী বাবা ? আজ বৃহস্পতিবার, মাঝে তো কেবল দুটাে দিন আছে।