পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(RN) রবীন্দ্র-রচনাবলী বিমলার আত্মকথা সেই সময়ে হঠাৎ সমস্ত বাংলাদেশের চিত্ত যে কেমন হয়ে গেল তা বলতে পারি নে। ষাট হাজার সগরসন্তানের ছাইয়ের পরে এক মুহূর্তে যেন ভাগীরথীর জল এসে স্পর্শ করলে। কত যুগযুগান্তরের ছাই, রসাতলে পড়ে ছিল— কোনো আগুনের তাপে জ্বলে না, কোনো রসের মিশালে দানা বাধে না— সেই ছাই হঠাৎ একেবারে কথা কয়ে উঠল ; বললে ; এই-যে আমি ! বইয়ে পড়েছি, গ্ৰীস দেশের কোন মূর্তিকর দেবতার বরে আপনার মূর্তির মধ্যে প্রাণসঞ্চার করেছিলেন, কিন্তু সেই রূপের থেকে প্ৰাণের মধ্যে একটা ক্রমশ বিকাশ, একটা সাধনার যোগ আছে ; কিন্তু আমাদের দেশের শ্মশানের ভস্মরাশির মধ্যে সেই রূপের ঐক্য ছিল কোথায় ? সে যদি পাথরের মতো আঁট শক্ত জিনিস হত তা হলেও তো বুঝতুম— অহল্যা পাষাণীও তো একদিন মানুষ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এ যে সব ছড়ানো, এ যে সৃষ্টিকর্তার মুঠোর ফাঁক দিয়ে কেবলই গলে গলে পড়ে, বাতাসে উড়ে উড়ে যায়, এ যে রাশ হয়ে থাকে, কিছুতে এক হয় না। অথচ সেই জিনিস হঠাৎ একদিন আমাদের ঘরের আঙিনার কাছে এসে মেঘগর্জনে বলে উঠল ; আয়মহং ভোঃ ! তাই আমাদের সেদিন মনে হল, এ সমস্তই অলৌকিক । এই বর্তমান মুহুর্ত কোনো সুধারসোন্মত্ত দেবতার মুকুটের থেকে মানিকের মতো একেবারে আমাদের হাতের উপর খসে পড়ল ; আমাদের ওষুধের মতো যা খুঁজে বের করি নি, যা কিনে আনি নি, যা কোনো চিকিৎসকের কাছ থেকে পাওয়া নয়, যা আমাদের স্বপ্নলব্ধ । সেইজন্যে মনে হল, আমাদের সব দুঃখ সব তাপ আপনি মন্ত্রে সেরে যাবে। সম্ভব-অসম্ভবের কোনো সীমা কোথাও রইল না । কেবলই মনে হতে লাগল, এই হল বলে, হল বলে । আমাদের সেদিন মনে হয়েছিল, ইতিহাসের কোনো বাহন নেই, পুষ্পকরথের মতো সে আপনি চলে আসে । অন্তত তার মাতলিকে কোনো মাইনে দিতে হয় না, তার খোরাকির জন্য কোনো ভাবনা নেই, কেবল ক্ষণে ক্ষণে তার মদের পেয়ালা ভর্তি করে দিতে হয়- আর তার পরেই হঠাৎ একেবারে সশরীরে স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি । আমার স্বামী যে অবিচলিত ছিলেন তা নয় । কিন্তু সমস্ত উত্তেজনার মধ্যে তঁাকে যেন একটা বিষাদ এসে আঘাত করত। যেটা সামনে দেখা যাচ্ছে তার উপর দিয়েও তিনি যেন আর একটা-কিছুকে দেখতে পেতেন । মনে আছে সন্দীপের সঙ্গে তর্কে তিনি একদিন বলেছিলেন, সৌভাগ্য হঠাৎ এসে আমাদের দরজার কাছে হাক দিয়ে যায় কেবল দেখাবার জন্যে যে তাকে গ্ৰহণ করবার শক্তি আমাদের নেই, তাকে ঘরের মধ্যে নিমন্ত্রণ করে বসাবার কোনো আয়োজন আমরা করি নি । সন্দীপ বললেন, দেখো নিখিল, তুমি দেবতাকে মান না, সেইজন্যেই এমন নাস্তিকের মতো কথা কও । আমরা প্রত্যক্ষ দেখছি দেবী বর দিতে এসেছেন, আর তুমি অবিশ্বাস করছি ? আমার স্বামী বললেন, আমি দেবতাকে মানি, সেইজন্যেই অন্তরের মধ্যে নিশ্চিত জানি তার পূজা আমরা জোটাতে পারলুম না। বর দেবার শক্তি দেবতার আছে, কিন্তু বর নেবার শক্তি আমাদের থাকা फ़ारे ! আমার স্বামীর এইরকমের কথায় আমার ভারি রাগ হত । আমি তাকে বললুম, তুমি মনে কর দেশের এই উদ্দীপনা এ কেবলমাত্র একটা নেশা । কিন্তু নেশায় কি শক্তি দেয় না ? তিনি বললেন, শক্তি দেয়, কিন্তু অস্ত্র দেয় না । আমি বললুম, শক্তি দেবতা দেন, সেইটেই দুর্লভ, আর অস্ত্ৰ তো সামান্য কামারেও দিতে পারে। স্বামী হেসে বললেন, কামার তো আমনি দেয় না, তাকে দাম দিতে হয় । সন্দীপ বুক ফুলিয়ে বললেন, দাম দেব গো দেব। স্বামী বললেন, যখন দেবে তখন আমি উৎসবের রোশন চৌকি বায়না দেব |