পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ঘরে-বাইরে ৫৯১ শেষে ফিরে যাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ডাকলুম, বিমল ; সে থমকে দাঁড়ালো, তার পিঠ ছিল আমার দিকে । আমি তাকে হাতে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে এলুম। ঘরে এসেই মেঝের উপর পড়ে মুখের উপর একটা বালিশ আঁকড়ে ধরে তার কান্না। আমি একটি কথা না বলে তার হাত ধরে মাথার কাছে বসে রইলুম। : কান্নার বেগ থেমে গিয়ে উঠে বসতেই, আমি তাকে আমার বুকের কাছে টেনে নেবার চেষ্টা করলুম। সে একটু জোর করে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের উপর বারবার মাথা ঠেকিয়ে প্ৰণাম করতে লাগল। আমি পা সরিয়ে নিতেই সে দুই হাত দিয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরে গদগদ স্বরে বললে, না না না, তোমার পা সরিয়ে নিয়াে না, আমাকে পুজো করতে দাও। আমি তখন চুপ করে রইলুম। এ পূজায় বাধা দেবার আমি কে ! যে পূজা সত্য সে পূজার দেবতাও সত্য- সে দেবতা কি আমি যে আমি সংকোচ করব ? বিমলার আত্মকথা চলো, চলো, এইবার বেরিয়ে পড়ে। সকল ভালোবাসা যেখানে পূজার সমুদ্রে মিশেছে সেই সাগরসংগমে | সেই নির্মল নীলের অতলের মধ্যে সমস্ত পঙ্কের ভর মিলিয়ে যাবে। আর আমি ভয় করি নে, আপনাকেও না, আর-কাউকেও না । আমি আগুনের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি ; যা পোড়বার তা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, যা বাকি আছে তার আর মরণ নেই। সেই আমি আপনাকে নিবেদন করে দিলুম তীর পায়ে যিনি আমার সকল অপরাধকে তীর গভীর বেদনার মধ্যে গ্ৰহণ করেছেন । আজ রাত্রে কলকাতায় যেতে হবে । এতক্ষণ অন্তর-বাহিরের নানা গোলমালে জিনিসপত্র গোছাবার কাজে মন দিতে পারি নি। এইবার বাক্সগুলো টেনে নিয়ে গোছাতে বসলুম। খানিক বাদে দেখি আমার স্বামীও আমার পাশে এসে জুটলেন । আমি বললুম, ন, ও হবে না। তুমি যে একটু ঘুমিয়ে নেবে। আমাকে কথা দিয়েছ। 像 আমার স্বামী বললেন, আমিই যেন কথা দিয়েছি, কিন্তু আমার ঘুম তো কথা দেয় নি, তার যে দেখা নেই । আমি বললুম, না, সে হবে না তুমি শুতে যাও । । তিনি বললেন, তুমি একলা পারবে কেন ? খুব পারব। আমি না হলেও তোমার চলে এ জাক তুমি করতে চাও করো, কিন্তু তুমি না হলে আমার চলে না। তাই একলা-ঘরে কিছুতেই আমার ঘুম এল না। এই বলে তিনি কাজে লেগে গেলেন । এমন সময়ে বেহার এসে জানালে, সন্দীপবাবু এসেছেন, তিনি খবর দিতে বললেন । খবর কাকে দিতে বললেন সে কথা জিজ্ঞাসা করবার জোর ছিল না। আমার কাছে এক মুহুর্তে আকাশের আলোটা যেন লজ্জাবতী লতার মতো সংকুচিত হয়ে গেল । আমার স্বামী বললেন, চলো বিমল, শুনে আসি সন্দীপ কী বলে। ও তো বিদায় নিয়ে চলে গিয়েছিল, আবার যখন ফিরে এসেছে তখন বােধ হয় বিশেষ কোনো কথা আছে। যাওয়ার চেয়ে না-যাওয়াটাই বেশি লজ্জা বলে স্বামীর সঙ্গে বাইরে গেলুম। বৈঠকখানার ঘরে সদীপ দাড়িয়ে দেয়ালে টাঙানাে ছবি দেখছিল। আমরা যেতেই বলে উঠল, তোমরা ভােবছ লোকটা ফেরে কেন ? সৎকার সম্পূর্ণ শেষ না হলে প্রেত বিদায় হয় না। এই বলে চাদরের ভিতর থেকে সে একটা রুমালের পুঁটলি বের করে টেবিলের উপরে খুলে ধরলে। সেই গিনিগুলো । বললে, নিখিল, ভুল কোরো না, ভেবাে না হঠাৎ তোমাদের সংসর্গে পড়ে