পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტპ\ტ রবীন্দ্র-রচনাবলী দস্তুরমত রাস্তায় চলতে গেলে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলবার জো থাকে না । কিন্তু প্ৰাপ্য জিনিসের চেয়ে ফাউ যেমন বেশি ভালো লাগে তেমনি অধিকাংশ সময়েই অপ্রাসঙ্গিক কথাটায় বেশি আমোদ পাওয়া যায় ; মূল কথাটার চেয়ে তার আশপাশের কথাটা বেশি মনােরম বােধ হয় ; অনেক সময়ে রামের চেয়ে হনুমান এবং লক্ষ্মণ, যুধিষ্ঠিরের চেয়ে ভীষ্ম এবং ভীম, সূর্যমুখীর চেয়ে কমলমণি বেশি প্রিয় বলে বোধ হয় । অবশ্য, সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক কথা বললে একেবারে পাগলামি করা হয় ; কিন্তু তাই বলে নিজের নাসাগ্রভাগের সমসূত্র ধরে ভূমিকা থেকে উপসংহার পর্যন্ত একেবারে সােজা লাইনে চললে নিতান্ত কলে-তৈরি প্রবন্ধের সৃষ্টি হয়, মানুষের হাতের কাজের মতো হয় না। সেরকম আঁটা-আঁটি প্রবন্ধের বিশেষ আবশ্যক আছে। এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না ; কিন্তু সর্বত্র তারই বড়ো বাহুল্য দেখা যায়। সেগুলো পড়লে মনে হয় যেন সত্য তার সমস্ত সুসংলগ্ন যুক্তিপরম্পরা নিয়ে একেবারে সম্পূর্ণভাবে কোথা থেকে আবির্ভূত হল ; মানুষের মনের মধ্যে সে যে মানুষ হয়েছে, সেখানে তার যে আরো অনেকগুলি সমবয়সী সহােদর ছিল, একটি বৃহৎ বিস্তৃত মানসপুরে যে তার একটি বিচিত্র বিহারভূমি ছিল, লেখকের প্রাণের মধ্যে থেকেই সে যে প্রাণ লাভ করেছে, তা তাকে দেখে মনে হয় না ; এমন মনে হয় যেন কোনো ইচ্ছাময় দেবতা যেমন বললেন “অমুক প্রবন্ধ হউক অমনি অমুক প্ৰবন্ধ হল : লেট দেয়ার বি লাইট অ্যান্ড দেয়ার ওআজ লাইট | এইজন্য তাকে নিয়ে কেবল আমাদের মাথার খাটুনি হয়, কেবলমাত্র মগজ দিয়ে সেটাকে হজম করবার চেষ্টা করা হয় ; আমাদের মানসপুরে যেখানে আমাদের নানাবিধ জীবন্ত ভােব জন্মাচ্ছে খেলছে এবং বাড়ছে সেখানে তার স্বর পরিচিতভাবে প্ৰবেশ করতে পারে না ; প্রস্তুত হয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে হয়, সাবধান হয়ে তার সঙ্গে কথা কইতে হয় ; তার সঙ্গে কেবল আমাদের একাংশের পরিচয় হয় মাত্র, ঘরের লোকের মতো সর্বাংশের পরিচয় ठूश क्रा | ম্যাপে এবং ছবিতে অনেক তফাত । ম্যাপে পার্সপেকটিভ থাকতে পারে না ; দূর নিকটের সমান ওজন, সর্বত্রই অপক্ষপাত ; প্রত্যেক অংশকেই সূক্ষ্মবিচারমত তার যথােপরিমাণ স্থান নির্দেশ করে দিতে হয় । কিন্তু ছবিতে অনেক জিনিস বাদ পড়ে ; অনেক বড়ো ছোটাে হয়ে যায় ; অনেক ছোটাে বড়ে, হয়ে ওঠে। কিন্তু তবু ম্যাপের চেয়ে তাকে সত্য মনে হয়, তাকে দেখবামাত্রই এক মুহুর্তে আমাদের সমস্ত চিত্ত তাকে চিনতে পারে । আমরা চোখে যে ভুল দেখি তাকে সংশোধন করতে গেলে ছবি হয় না, ম্যাপ হয়, তাকে মাথা খাটিয়ে আয়ত্ত করতে হয় । কিন্তু এইরকম আংশিক চেষ্টা ভারি শ্ৰান্তিজনক । যাতে আমাদের সমস্ত প্রকৃতি উৎসাহের সঙ্গে যোগ দেয় না, পরস্পরের ভার লাঘব করে না, নিজ নিজ অংশ বন্টন করে নেয় না, তাতে আমাদের তেমন পরিপুষ্টি-সাধন হয় না । যে কারণে খনিজ পদার্থের চেয়ে প্রাণিজ পদার্থ আমরা শীঘ গ্রহণ এবং পরিপাক করতে পারি, সেই কারণে একেবারে অমিশ্র খাটি সত্য কঠিন যুক্তি-আকারে আমাদের অধিকাংশ পাকযন্ত্রের পক্ষেই গুরুপাক । এইজন্য সত্যকে মানবের জীবনাংশের সঙ্গে মিশ্রিত করে দিলে সেটা লাগে ভালো । সেই কাজ করতে গেলেই প্রথমত একটা সত্যকে এক দমে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আগাগোড়া দেওয়া যায় না ; কারণ, অধিকাংশ সত্যই আমরা মনের মধ্যে আভাসরূপে পাই এবং তার পশ্চাতে আমাদের মাথাটাকে প্রেরণ করে গড়ে পিটে তার একটা আগা-গোড়া খাড়া করে তুলতে চেষ্টা করি । সেটাকে বেশ একটা সংগত এবং সম্পূৰ্ণ আকার না দিলে একটা চলনসই প্রবন্ধ হল না, মনে করি । এইজন্যে নানাবিধ কৃত্রিম কাঠ খড় দিয়ে তাকে নিয়ে একটা বড়োগোছের তাল পাকিয়ে তুলতে হয় । আমি ইংরিজি কাগজ এবং বইগুলো যখন পড়ি তখন অধিকাংশ সময়েই আমার এই কথা মনে হয় যে, একটা কথাকে একটা প্ৰবন্ধ কিংবা একটা গ্রন্থে পরিণত করতেই হবে এই চেষ্টা থাকতে প্রতিদিনকার ইংরাজি সাহিত্যে যে কত বাজে বকুনির প্রাদুর্ভাব হয়েছে তার আর সংখ্যা নেই- এবং সত্যটুকুকে খুঁজে বের করা কত দুঃসাধ্য হয়েছে! যে কথাটা বলা হচ্ছে সেটা আসলে কত সহজ এবং