পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ SOS বকিতে থাকে তখন রজনীর কী মর্মান্তিক ইচ্ছা হয় যে, আর কেহ সেখানে না আসে। যখন মহেন্দ্ৰ মাতাল অবস্থায় টালিতে টলিতে আইসে রজনী তাহাকে কোনো ক্ৰমে ঘরের মধ্যে লইয়া গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দেয়, তখন তাহার কতই না ভয় হয় পাছে আর কেহ দেখিতে পায়। অভাগিনী মহেন্দ্ৰকে । কোনো কথা বলিতে, পরামর্শ দিতে বা বারণ করিতে সাহস করিত না, তাহার যতদূর সাধ্য কোনোমতে মহেন্দ্রের দোষ আর কাহাকেও দেখিতে দিত না। মহেন্দ্রের অসমবৃত অবস্থায় রজনীর ইচ্ছা করিত তাহাকে বুক দিয়া ঢাকিয়া রাখে, যেন আর কেহ দেখিতে না পায়। কেহ তাহার সাক্ষাতে মহেন্দ্রের নিন্দা করিলে সে তাহার, প্ৰতিবাদ করিতে সাহস করিত না, অন্তরালে গিয়া ক্ৰন্দন করা ভিন্ন তাহার আর কোনো উপায় ছিল না । সে তাহার মহেন্দ্রের জন্য দেবতার কাছে কত প্রার্থনা করিয়াছে, কিন্তু মহেন্দ্ৰ তাহার মত্ত অবস্থায় রজনীর মরণ ভিন্ন কিছুই প্রার্থনা করে নাই। রজনী মনে মনে কহিত, ‘রাজনীর মরিতে কতক্ষণ, কিন্তু রজনী মরিলে তোমাকে কে দেখিবে ।” একদিন রাত্রি দুইটার সময় টলিতে টলিতে মহেন্দ্র ঘরে আসিয়া ভূমিতলে শুইয়া পড়িল। রজনী জাগিয়া জানালায় বসিয়াছিল, সে তাড়াতাড়ি কাছে আসিয়া বসিল । মহেন্দ্র তখন অচৈতন্য । রজনী ভয়ে ভয়ে ধীরে ধীরে কতক্ষণের পর মহেন্দ্রের মাথা কোলে তুলিয়া লইল । আর কখনো সে মহেন্দ্রের মাথা কোলে রাখে নাই ; সাহসে বুক বাধিয়া আজ রাখিল । একটি পাখা লইয়া ধীরে ধীরে বাতাস করিতে লাগিল। ভোরের সময় মহেন্দ্ৰ জাগিয়া উঠিল ; পাখা দূরে ছুড়িয়া ফেলিয়া কহিল, ‘এখানে কী করিতেছ। ঘুমাও গে না !! রজনী ভয়ে থাতমত খাইয়া উঠিয়া গেল ! মহেন্দ্র আবার ঘুমাইয়া পড়িল । প্ৰভাতের রৌদ্র মুক্ত বাতায়ন দিয়া মহেন্দ্রের মুখের উপর পড়িল, রজনী আস্তে আস্তে জানালা বন্ধ করিয়া দিল । 船 রজনী মহেন্দ্ৰকে যত্ন করিত, কিন্তু প্ৰকাশ্যভাবে করিতে সাহস করিত না । সে গোপনে মহেন্দ্রের খাবার গুছাইয়া দিত, বিছানা বিছাইয়া দিত এবং সে অল্পস্বল্প যাহা-কিছু মােসহরা পাইত তাহা মহেন্দ্রের খাদ্য ও অন্যান্য আবশ্যকীয় দ্রব্য কিনিতেই ব্যয় করিত, কিন্তু এ-সকল কথা কেহ জানিতে পাইত না। গ্রামের বালিকারা, প্রতিবেশিনীরা, এত লোক থাকিতে নির্দোষী রজনীরই প্ৰতি কার্যে দোষারোপ করিত, এমন-কি, বাড়ির দাসীরাও মাঝে মাঝে তাহাকে দুই-এক কথা শুনাইতে ত্রুটি করিত না, কিন্তু রজনী তাহাতে একটি কথাও কহিত না- যদি কহিতে পারিত তবে অত কথা শুনিতেও হইত না । রাত্রি প্রায় দুই প্রহর হইবে । মেঘ করিয়াছে, একটু বাতাস নাই, গাছে গাছে পাতায় পাতায় হাজার হাজার জোনাকি-পোকা মিট মিট করিতেছে। মোহিনীদের বাড়িতে একটি মানুষ আর জাগিয়া নাই, এমন সময়ে তাহাদের খিড়কির দরজা খুলিয়া দুইজন তাহাদের বাগানে প্রবেশ করিল। একজন বৃক্ষতলে দাড়াইয়া রহিল, আর একজন গৃহে প্রবেশ করিল। যিনি বৃক্ষতলে দাড়াইয়া রহিলেন তিনি গদাধর, যিনি গৃহে প্রবেশ করিলেন তিনি মহেন্দ্র । দুইজনেরই অবস্থা বড়ো ভালো নহে, গদাধরের এমন ৰক্তৃতা করিবার ইচ্ছা হইতেছে যে তাহা বলিবার নহে এবং মহেন্দ্রের পথের মধ্যে এমন শয়ন করিবার ইচ্ছা হইতেছে যে কী বলিব । ঘোরতর বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ হইল, গদাধর দাড়াইয়া ভিজিতে লাগিলেন । পরোপকারের জন্য কী কষ্ট না সহ্য করা যায়, এমন-কি এখনই যদি বজু পড়ে। গদাধর তাহা মাথায় করিয়া লইতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু এই কথাটা অনেকক্ষণ ভাবিয়া দেখিলেন যে, এখনই তাঁহাতে তিনি প্রস্তুত নহেন ; বাচিয়া থাকিলে পৃথিবীর অনেক উপকার করিতে পরিবেন। বৃষ্টিবজের সময় বৃক্ষতলে দাড়ানো ভালো নয় জানিয়া একটি ফাঁকা জায়গায় গিয়া বসিলেন, বৃষ্টি দ্বিগুণ বেগে পড়িতে লাগিল । t এ দিকে মহেন্দ্র পা টিপিয়া টিপিয়া মোহিনীর ঘরের দিকে চলিল, যতই সাবধান হইয়া চলে ততই উঠিলেন, “মােহিনী! দেখ তাে বিড়াল বুঝি " | দিদিমার গলা শুনিয়া মহেন্দ্ৰ তাড়াতাড়ি সরিবার চেষ্টা দেখিলেন। সরিতে গিয়া একরাশি