পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/১৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১২৮ রবীন্দ্র-রচনাবলী দেখিয়া আরো দুই হস্ত ব্যবধানে যাইবার সংকল্প করিতেছিলেন। কিন্তু মহেন্দ্রের যে তাহার কাছে যাওয়াই লক্ষ্য ছিল, ইহা কল্পনা করিয়া সে দাসীটি মনে-মনে মহা পরিতৃপ্ত হইয়াছিল। যাহা হউক, এই দাসী গিয়া ভীত নরেন্দ্ৰকে অনেক আশ্বাস দিয়া ডাকিয়া আনিল। নরেন্দ্ৰ মহেন্দ্ৰকে দেখিয়া কিছুমাত্র আশ্চর্য হইল না, সে যেন তাহারই প্ৰতীক্ষা করিতেছিল। কিন্তু মহেন্দ্র নরেন্দ্ৰকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিল- এমন পরিবর্তন সে আর কাহারও দেখে নাই। অনাবৃত দেহ, অল্পপরিসর জীর্ণ মলিন বস্ত্ৰে হাঁটু পর্যন্ত আচ্ছাদিত। মুখশ্ৰী অত্যন্ত বিকৃত হইয়া গিয়াছে, চক্ষু জ্যোতিহীন, কেশপাশ অপরিচ্ছন্ন ও বিশৃঙ্খল, সর্বদাই হাত থর থর করিয়া কঁাপিতেছে, বর্ণ এমন মলিন হইয়া গিয়াছে যে আশ্চর্য হইতে হয়- তাহাকে দেখিলেই কেমন এক প্রকার ঘূণা ও সংকোচ উপস্থিত হয়। নরেন্দ্ৰ অতি শান্তভাবে মহেন্দ্ৰকে তাহার নিজের ও র্তাহার সংক্রান্ত সমস্ত লোকের কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলেন, কাজকর্ম কিরূপ চলিতেছে তাহাও খোজ লইলেন। মহেন্দ্র নরেন্দ্রের এই অতি শান্তভাব দেখিয়া অত্যন্ত অবাক হইয়া গিয়াছেন- মহেন্দ্ৰকে দেখিয়া নরেন্দ্র কিছুমাত্র লজ্জা বা সংকোচ বোধ করেন নাই । মহেন্দ্র আর কিছু না বলিয়া নরেন্দ্রের চিঠিটি তাহার হস্তে দিল। সে অবিচলিত ভাবে ঘাড় নাড়িয়া। কহিল, “ই মশায়, সম্প্রতি অবস্থা মন্দ হওয়াতে কিছু দেনা হইয়াছে, তাই বড়ো জড়াইয়া পড়িয়াছি।” মহেন্দ্ৰ কহিলেন, “তা, আপনার স্ত্রীর নিকট সাহায্য চাহিবার অর্থ কী । উপার্জনের ভার তো আপনার হাতে । আর, তিনি অর্থ পাইবেন কোথা ।” নির্লজ্জ নরেন্দ্ৰ কহিল, “সেকি কথা ! আমি সন্ধান লইয়াছি, আজকাল সে খুব উপার্জন করিতেছে। দিনকতক স্বরূপবাবু তাহাকে পালন করিয়াছিলেন, শুনিলাম আজকাল আর কোনো বাবুর আশ্রয়ে আছে।” মহেন্দ্ৰ ইচ্ছাপূর্বক কথাটার মন্দ অর্থনা লইয়া কিঞ্চিৎ দৃঢ় স্বরে কহিলেন, “আপনি জানেন তিনি আমার বাটীতেই আছেন।” । নরেন্দ্ৰ কহিলেন, “আপনারই বাটীতে ? সে তো ভালোই।” মহেন্দ্ৰ কহিলেন, “কিন্তু তাহার কাছে অর্থ থাকিবার তো কোনো সম্ভাবনা নাই।” নরেন্দ্ৰ কহিলেন, “তা যদি হয়, তবে আমার চিঠির উত্তরে সে কথা লিখিয়া দিলেই হইত।” মহেন্দ্ৰ যেরূপ ভালো মানুষ, অধিক গোলযোগ করা তাহার কর্ম নয়। বকবিকি করিতে আরম্ভ করিলে তাহার। আর অন্ত হইবে না জানিয়া মহেন্দ্ৰ প্ৰস্তাব করিলেন- নরেন্দ্ৰ যদি তাহার কু-অভ্যাসগুলি পরিত্যাগ করেন তবে তিনি তঁহার সাহায্য করবেন। নরেন্দ্ৰ আকাশ হইতে পড়িল ; কহিল, “কু-অভ্যাস কী মশায় ! নূতন কু-অভ্যাস তো আমার কিছুই হয় নাই, আমার যা অভ্যাস আছে সে তো আপনি সমস্ত জানেন ।” এই কথায় ভালোমানুষ মহেন্দ্র কিছু অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল, সে তেমন ভালো উত্তর দিতে পারিল “না। নরেন্দ্র পূর্বে এত কথা কহিতে জনিত না, বিশেষ মহেন্দ্রের কাছে কেমন একটু সংকোচ অনুভব। সুঠি বধিতেই সভাৰ কথাফাির্টকাট কৃতি পিৰয়ছে। তার স্বভাব আকর্মকাল য়া গিয়াছে । . মহেন্দ্ৰ শীঘ্র শীঘ্ৰ তাহার সহিত মীমাংসা করিয়া লইয়া তাহাকে টাকা দিলেন ও কহিলেন, ভবিষ্যতে নরেন্দ্ৰ যেন তাহার স্ত্রীকে অন্যায় ভয় দেখাইয়া চিঠি না লেখেন। মহেন্দ্ৰ সেই আদ্র বাষ্পময় ঘর হইতে বাহির হইয়া বঁচিলেন ও পথের মধ্যে একটা ডাক্তারখানা হইতে একশিশি কুইনাইন কিনিয়া লইয়া যাইবেন বলিয়া নিশ্চয় করিলেন। দ্বারের নিকট দাসীটি বসিয়াছিল, সে মহেন্দ্ৰকে দেখিয়া অতি মধুর দুই-তিনটি হাস্য ও কটাক্ষ বর্ষণ করিল ও মনে-মনে ঠিক দিয়া রাখিল— সেই কটাক্ষের প্রভাবে, মলয়-সামীরণে, চন্দ্ৰকিরণে মহেন্দ্ৰ বাসায় গিয়া মরিয়া থাকিবে । ।