পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

RXR রবীন্দ্র-রচনাবলী আপন দলের প্রভাবকে প্রতিষ্ঠিত করে অন্য দলের দাসত্বের উপরে । মানুষ দীর্ঘ কাল ধরে এই কাজ করে এসেছে। কিন্তু তবু বলব। এটা অমানুষিক । তাই দাসনির্ভরতার ভিত্তির উপরে মানুষের ঐশ্বৰ্য স্থায়ী হতে পারে না। এতে কেবল যে দাসেদের দুৰ্গতি হয় তা নয়, প্ৰভুদেরও এতে বিনাশ ঘটায়। যাদের আমরা অপমানিত করে পায়ের তলায় ফেলি তারাই আমাদের সম্মুখপথে পদক্ষেপের বাধা । তারা গুরুভারে আমাদের নীচের দিকে টেনে রাখে। যাদের আমরা হীন করি তারা ক্রমশই আমাদের হেয় করে । মানুষ-খেগো সভ্যতা রোগে জীৰ্ণ হবে, মরবে। মানুষের দেবতার এই বিধান । ভারতবর্ষে মানুষোচিত সম্মান থেকে যাদের আমমা বঞ্চিত করেছি। তাদের আগীেরবে আমরা সমস্ত ভারতবর্ষের আগৌরব ঘটিয়েছি । আজ ভারতে কত সহস্ৰ লোক কারাগারে রুদ্ধ, বন্দী । মানুষ হয়ে পশুর মতো তারা পীড়িত, অবমানিত । মানুষের এই পুঞ্জীভূত অবমাননা সমস্ত রাজ্যশাসনতন্ত্রকে অপমানিত করছে, তাকে গুরুভারে দুরূহ করছে। তেমনি আমরাও অসম্মানের বেড়ার মধ্যে বন্দী করে রেখেছি সমাজের বৃহৎ এক দলকে । তাদের হীনতার ভার বহন করে আমরা এগোতে পারছি নে । বন্দীদশা শুধু তো কারাপ্রাচীরের মধ্যে নয়। মানুষের অধিকার-সংক্ষেপ করাই তো বন্ধন । সম্মানের খর্বতার মতো কারাগার তো নেই। ভারতবর্ষে সেই সামাজিক কারাগারকে আমরা খণ্ডে খণ্ডে বড়ো করেছি। এই বন্দীর দেশে আমরা মুক্তি পাব কী করে। যারা মুক্তি দেয় তারাই তো মুক্ত হয়। এতদিন এইভাবে চলছিল ; ভালো করে বুঝি নি। আমরা কোথায় তলিয়ে ছিলাম । সহসা ভারতবর্ষ আজ মুক্তির সাধনায় জেগে উঠল। পণ করলাম, চিরদিন বিদেশী শাসনে মনুষ্যত্বকে পঙ্গু করে রাখার এ ব্যবস্থা আর স্বীকার করব না । বিধাতা ঠিক সেই সময় দেখিয়ে দিলেন কোথায় আমাদের পরাভাবের অন্ধকার গহবরগুলো। আজ ভারতে মুক্তিসাধনার তাপস র্যারা তাদের সাধনা বাধা পেল তাদেরই কাছ থেকে যাদের আমরা অকিঞ্চিৎকর করে রেখেছি। যারা ছোটাে হয়ে ছিল তারাই আজ বড়োকে করেছে। অকৃতাৰ্থ। তুচ্ছ বলে যাদের আমরা মেরেছি। তারাই আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো মার মারছে। এক ব্যক্তির সঙ্গে আর-এক ব্যক্তির শক্তির স্বাভাবিক উচ্চনীচতা আছে । জাতি N88 তেমন দেখা যায়। উন্নতির পথে সকলে সমান দূর এগোতে পারে নি। সেইটােকে উপলক্ষ করে সেই পশ্চাদবতীদেরকে অপমানের দুর্লঙ্ঘ্য বেড়া তুলে দিয়ে স্থায়ী ভাবে যখনই পিছিয়ে রাখা যায় তখনই পাপ জমা হয়ে ওঠে। তখনই অপমানবিষ দেশের এক অঙ্গ থেকে সর্ব অঙ্গে সঞ্চারিত হতে থাকে। এমনি করে মানুষের সম্মান থেকে যাদের নির্বাসিত করে দিলুম তাদের আমরা হারালুম। আমাদের দুর্বলতা ঘটল সেইখানেই, সেইখানেই শনির রন্ধ। এই রন্ধ দিয়েই ভারতবর্ষের পরাভব তাকে বারে বারে নত করে দিয়েছে। তার ভিতের গাথুনি আলগা, আঘাত পাবা মাত্র ভেঙে ভেঙে পড়েছে। কালক্রমে যে ভেদ দূর হতে পারত তাকে আমরা চেষ্টা করে, সমাজরীতির দোহাই দিয়ে, স্থায়ী করে তুলেছি। আমাদের রাষ্ট্রক মুক্তিসাধনা কেবলই ব্যর্থ হচ্ছে এই ভেদবুদ্ধির অভিশাপে । যেখানেই এক দলের অসম্মানের উপর আর-এক দলের সম্মানকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। সেইখানেই ভার-সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে বিপদ ঘটে । এর থেকেই বােঝা যায়, সামাই মানুষের মূলগত ধর্ম। য়ুরোপে এক রাষ্ট্রজাতির মধ্যে অন্য ভেদ যদি বা না থাকে, শ্রেণীভেদ আছে। শ্রেণীভেদে সম্মান ও সম্পদের পরিবেশন সমান হয় না । সেখানে তাই ধনিকের সঙ্গে কমিকের অবস্থা যতই অসমান হয়ে উঠছে। ততই সমাজ টলমল করছে। এই অসাম্যের ভরে সেখানকার সমাজব্যবস্থা প্ৰত্যহই পীড়িত হচ্ছে। যদি সহজে সাম্য স্থাপন হয় তবেই রক্ষা, নইলে নিস্কৃতি নেই। মানুষ যেখানেই মানুষকে পীড়িত করবে: সেখানেই তার সমগ্ৰ মনুষ্যত্ব আহত হবেই ; সেই আঘাত মৃত্যুর দিকেই নিয়ে যায়। সমাজের মধ্যেকার এই অসাম্য, এই অসম্মানের দিকে, মহাত্মাজি অনেকদিন থেকে আমাদের লক্ষ নির্দেশ করেছেন । তবুও তেমন একান্ত চেষ্টায় এই দিকে আমাদের সংস্কারকার্য প্রবর্তিত হয়নি। চরখা। ও খন্দরের দিকে আমরা মন দিয়েছি, আর্থিক দুৰ্গতির দিকে দৃষ্টি পড়েছে, কিন্তু সামাজিক পাপের দিকে নয়। সেইজন্যেই আজ এই দুঃখের দিন এল। আর্থিক দুঃখ অনেকটা এসেছে বাইরে থেকে, তাকে