পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (চতুর্দশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NRSR8 রবীন্দ্র-রচনাবলী সত্য তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। মনের সঙ্গে মন মিলতে থাকলে আপনি জাগে খুশি । সেই খুশি সৃজন-শক্তিশীল। আশ্রমের শিক্ষাদান এই খুশির দান। র্যাদের মনে কর্তব্যবােধ আছে কিন্তু খুশি নেই। তাদের দোসরা পথ । - পুরাকালে আমাদের দেশের গৃহস্থ ধানের দায়িত্ব স্বীকার করতেন। যথাকালে যথাস্থানে যথাপত্রে দান করার দ্বারা তিনি নিজেকেই জানতেন। সার্থক । তেমনি যিনি জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, জ্ঞান বিতরণের দায়িত্ব তিনি স্বতই গ্ৰহণ করতেন । তিনি জানতেন, যা পেয়েছেন তা দেবার সুযোগ না। পেলে পাওয়াই থাকে অসম্পূর্ণ। গুরুশিষ্যের মধ্যে এই পরস্পরসাপেক্ষ সহজ সম্বন্ধকেই আমি বিদ্যাদানের প্রধান মাধ্যস্থ্য বলে জেনেছি। আরো একটি কথা আমার মনে ছিল। গুরুর অন্তরে ছেলেমানুষটি যদি একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় তা হলে তিনি ছেলেদের ভার নেবার অযোগ্য হন। শুধু সমীপ্য নয়, উভয়ের মধ্যে প্রকৃতিগত সাযুজ্য ও সাদৃশ্য থাকা চাই। নইলে দেনা-পাওনায় নাড়ীর যোগ থাকে না। নদীর সঙ্গে যদি প্রকৃত শিক্ষকের তুলনা করি তবে বলব, কেবল ডাইনে বঁায়ে কতকগুলো বুড়ো বুড়ো উপনদী-যোগেই তিনি পূর্ণ নন। তার প্রথম আরম্ভের লীলাঞ্চল কলহাস্যমুখর ঝরনার প্রবাহ পাথরগুলোর মধ্যে হারিয়ে যায় নি। যিনি জাত-শিক্ষক ছেলেদের ডাক পেলেই তার আপনি ভিতরকার আদিম ছেলেটা আপনি ছুটে আসে । মোটা গলার ভিতর থেকে উচ্ছসিত হয়। প্ৰাণে-ভরা কঁচা হাসি । ছেলেরা যদি কোনো দিক থেকেই তাকে স্বশ্রেণীর জীব বলে চিনতে না পারে, যদি মনে করে লোকটা যেন প্রাগৈতিহাসিক মহাকায় প্রাণী, তবে থাকার আড়ম্বর দেখে নিৰ্ভয়ে সে তার কাছে হাত বাড়াতেই পারবে না । সাধারণত আমাদের গুরুরা প্রবীণতা সপ্রমাণ করতেই চান, প্রায়ই ওটা শাস্তায় কর্তৃত্ব করবার প্রলোভনে, ছেলেদের আঙিনায় চোপদার না নিয়ে এগোলে সম্রম নষ্ট হবার ভয়ে তারা সতর্ক । তাই পাকা শাখায় কচি শাখায় ফুল ফোটাবার ফল ফলাবার মর্মগত সহযোগ রুদ্ধ হয়ে থাকে। আর-একটা গুরুতর কথা আমার মনে ছিল । ছেলেরা বিশ্বপ্রকৃতির অত্যন্ত কাছের সামগ্ৰী । আরামকেদারায় তারা আরাম চায় না, গাছের ডালে তারা চায় ছুটি । বিরাট প্রকৃতির অন্তরে আদিম প্ৰাণের বেগ নিগৃঢ়ভাবে চঞ্চল, শিশুর প্রাণে সেই বেগ গতিসঞ্চার করে। জীবনের আরম্ভে অভ্যাসের দ্বারা অভিভূত হবার আগে কৃত্রিমতার জাল থেকে ছুটি পাবার জন্যে ছেলেরা ছটফট করতে থাকে, সহজ প্ৰাণলীলার অধিকার তারা দাবি করে বয়স্কদের শাসন এড়িয়ে । আরণ্যক ঋষিদের মনের মধ্যে ছিল চিরকালের ছেলে, তাই কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণের অপেক্ষা না রেখে তারা বলেছিলেন, যদিদং কিঞ্চ সৰ্বং প্রাণ এজাতি নিঃসৃতম— এই ফা-কিছু সমস্তই প্রাণ হতে নিঃসৃত হয়ে প্ৰাণেই কম্পিত হচ্ছে। এ কি বর্গস-এর বচন । এ মহান শিশুর বাণী । বিশ্বপ্রাণের এই স্পন্দন লাগতে দাও ছেলেদের দেহে মনে, শহরের বােবা কালা মরা দেওয়ালগুলোর বাইরে। আমাদের আশ্রমের ছেলেরা এই প্রাণময়ী প্রকৃতিকে কেবল যে খেলায় ধূলায় নানা রকম করে কাছে পেয়েছে তা নয়, আমি গানের রাস্তা দিয়ে নিয়ে গেছি তাদের মনকে প্রকৃতির রঙমহলে। তার পরে আশ্রমের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার কথা । মনে পড়ছে, কাদম্বরীতে একটি বর্ণনা আছেতপোবনে আসছে সন্ধ্যা, যেন গোষ্ঠে-ফিরে-আসা পাটলী হােমধেনুটির মতো। শুনে মনে পড়ে যায় সেখানে গোরু চরানো, গো দোহন, সমিধ্য আহরণ, অতিথি-পরিচর্যা, আশ্রম-বালকবালিকাদের দিনকৃত্য। এই সব কর্মপর্যায়ের দ্বারা তপোবনের সঙ্গে তাদের নৃত্য-প্রবাহিত জীবনের যোগধারা। প্রাণায়ামের ফঁাকে ফাকে কেবলই যে সামমন্ত্র আবৃত্তি তা নয়, সহকারিতার সখ্য বিস্তারে সকলে মিলে কর্মসমবায়ে। আমাদের আশ্রমে এই সতত-উদ্যমশীল কর্মসহযোগিতা কামনা করেছি। মাস্টারমশায় গোরু চরাবার কাজে ছেলেদের লাগালে তারা খুশি হত সন্দেহ নেই, দুৰ্ভাগ্যক্রমে এ যুগে তা সম্ভব হবে না। তবু শরীর মন খাটাবার কাজ বিস্তর আছে যা এ যুগে মানাত। কিন্তু হায় রে, পড়া মুখস্থ সর্বদাই থাকে বাকি, পাতা ভরে রয়েছে। কনজুগেশন অফ ইংরেজি ভাৰ্যস। তা হােক, আমি যে